মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করাই তার স্বভাব। এভাবে বাস করতে
হলে চাই একে অন্যের সাথে সহযোগিতা। এ কারণেই মানুষের প্রয়োজন পড়ে বিভিন্ন
সামাজিক অর্থনেতিক ও রাজনৈতিক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। জীবন
বাঁচাতে তিনটি জিনিসের প্রথম প্রয়োজন- খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান। এরপরই
মানুষ জীবনকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে মনোযোগ দেয় শিক্ষা, বিজ্ঞান,
শিল্পকলা, আইন প্রভৃতির উন্নয়নে। সমাজ জীবন বিকাশে মানুষের এ সমস্ত
কাজকর্মের একত্রিত রূপই হচ্ছে তার সংস্কৃতি। আর্যদের আগমনের পূর্বে বাংলার
প্রাচীন মানুষেরা একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গড়ে তুলেছিল। বাংলার
সমাজ-সংস্কৃতির এটাই সবচেয়ে প্রাচীন রূপ। পণ্ডিতদের মতে, এদের ভাষার নাম
ছিল ‘অষ্ট্রিক’। জাতি হিসেবে এদের বলা হতো নিষাদ। এরপর বাংলার ক্ষুদ্র
নৃগোষ্ঠীর সাথে মিশে যায় ‘আলপাইন’ নামে এক জাতি। আর্যরা এদেশে আসার পূর্বে
এরা মিলেমিশে বাংলার সংস্কৃতি গড়ে তোলে। বাঙালির জন প্রকৃতিতে বিভিন্ন
মানবগোষ্ঠীর ধারা এসে মিলিত হয়েছে। ফলে তাদের ‘সংকর-জন’ হিসেবে পরিচিত
করেছে। বহু বছর বিচিত্র আদান-প্রদান ও মিশ্রণের ফলে বাঙালির একটি নিজস্ব
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বৈশিষ্ট্য দাঁড়িয়েছে। ফলে অধিকাংশ বাঙালির মাথা গোল আকৃতির,
চুল কালো, চোখের মনি পাতলা হতে ঘন কালো, নাকের আকৃতি মোটামুটি মধ্যম,
গায়ের রং সাধারণত শ্যামলা, মুখমণ্ডলের গঠন মধ্যম আকৃতির অর্থাৎ গোল বা
লম্বা নয়। এ মধ্যম আকৃতির দেহ লক্ষণই বাঙালির বৈশিষ্ট্য।
প্রাচীন বাংলার সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি
প্রাচীন বাংলার সামাজিক জীবন
মৌর্য শাসনের পূর্বে ব্যাপক অর্থে বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে রাজনৈতিক পরিচয়
গড়ে ওঠেনি। এ সময়ে সমাজ বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। একে বলা হতো কৌম সমাজ।
আর্যদের পূর্বে কিছু কিছু ধর্মচিন্তা পরবর্তী সময়ে এদেশের হিন্দু ধর্মে
ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোর মধ্যে উলে- যোগ্য হলো-কর্মফল, জন্মান্তরবাদ, যোগ সাধনা
ইত্যাদি। এ যুগের অনেক সামাজিক প্রথা ও আচার-আচরণের প্রভাব পরবর্তী সময়ে
হিন্দু সমাজে লক্ষ করা যায়। যেমন- অতিথিদের পান-সুপারি খেতে দেয়া, শীবের
গীত গাওয়া, বিয়েতে গায়ে হলুদ দেয়া, ধূতি-শাড়ি পরা এবং মেয়েদের কপালে সিঁদুর
দেয়া ইত্যাদি।
আর্য সমাজের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অঙ্গ ছিল জাতিভেদ প্রথা। তারা দীর্ঘদিন ধরে
এদেশে বসবাস করার ফলে বাংলায়ও এ ব্যবস্থা চালু হয়। প্রাচীনকালে বাংলায়
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এ চার প্রকার বর্ণ ছিল। পরবর্তী সময়ে
আরও নানা প্রকার সঙ্কর অর্থাৎ মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়। সমাজে প্রত্যেক
জাতিরই নির্দিষ্ট পেশা ছিল। অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও পূজা পার্বন করা- এগুলো ছিল
ব্রাহ্মণদের নির্দিষ্ট কর্ম। তারা সমাজে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা লাভ করতেন।
ক্ষত্রিয়দের পেশা ছিল যুদ্ধ করা। ব্যবসা-বাণিজ্য করা ছিল বৈশ্যদের কাজ।
সবচেয়ে নিচু শ্রেণির শূদ্ররা সাধারণত কৃষিকাজ, মাছ শিকার ও অন্যান্য
ছোটখাটো কাজ করত। ব্রাহ্মণ ছাড়া বাকী সব বর্ণের মানুষ একে অন্যের সাথে
মেলামেশা করত। সাধারণত এক জাতির মধ্যেই বিবাহ হতো, তবে উচ্চ শ্রেণির বর ও
নিম্ন শ্রেণির কন্যার মধ্যে বিবাহও চালু ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এসব
ব্যাপারে কঠোর নিয়ম চালু হয়।
তখনকার দিনে বিদেশ ভ্রমণকারী বাঙালি পুরুষদের কোনো সুনাম ছিলনা। কিন্তু
বাঙ্গালি মেয়েদের গুণাবলীর জন্য সুখ্যাতি ছিল। মেয়েরা লেখাপড়া শিখত। সে
যুগে অবরোধ বা পর্দাপ্রথা ছিলনা। তবে বাংলার মেয়েদের কোনো প্রকার স্বাধীনতা
ছিলনা। একটিমাত্র স্ত্রী গ্রহণই ছিল সমাজের নিয়ম। তবে পুরুষেরা বহু স্ত্রী
রাখতে পারত। বিধবাকে নিরামিষ আহার করে সব ধরনের বিলাসিতা ত্যাগ করতে হতো।
স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকেও মৃত স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। এ
প্রথাকে বলা হয় ‘সতীদাহ প্রথা’। ধন-সম্পত্তিতে নারীদের কোনো আইনগত অধিকার
ছিলনা। বাংলার প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে বাঙালির উন্নত চরিত্রের কথা জানা যায়।
কিন্তু তাই বলে বাঙালির সামাজিক জীবনে কোনরূপ দুর্নীতি ও অশ-লতা ছিলনা, এমন
কথা বলা যায় না।
বাঙালির প্রধান খাদ্য বর্তমান সময়ের মত তখনও ছিল ভাত, মাছ, মাংস, শাক-সবজি,
দুধ, দধি, ঘৃত, ক্ষীর ইত্যাদি। চাউল হতে প্রস্তুত নানা প্রকার পিঠাও
জনপ্রিয় মুখরোচক খাবার ছিল। বাঙ্গালি ব্রাহ্মণেরা আমিষ খেতেন। তখন সকল
প্রকার মাছ পাওয়া যেত। পূর্ববঙ্গে ইলিশ ও শুঁটকি মাছ খুব প্রিয় খাবার ছিল।
তরকারির মধ্যে বেগুন, লাউ, কুমড়া, ঝিংগে, কাকরুল, কচু উৎপন্ন হতো। ফলের
মধ্যে আম, কাঁঠাল, কলা, তাল, পেঁপে, নারকেল, ইক্ষু পাওয়া যেত। তবে ডালের
কথা কোথাও বলা নেই। দুধ, নারকেলের পানি, ইক্ষুরস, তালরস ছাড়া মদ জাতীয় নানা
প্রকার পানীয় সুপ্রচলিত ছিল। ভাত, গম, ইক্ষু, গুড়, মধু ও তালরস গাঁজাইয়া
নানা প্রকার মদ তৈরি হতো। মদ জাতীয় নানা প্রকারের পানীয় পান করা হতো।
খাওয়া-দাওয়া শেষে মসলাযুক্ত পান খাওয়ার রীতি ছিল।
পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে রাজা-মহারাজা ও ধনীদের কথা বাদ দিলে বিশেষ কোনো
আড়ম্বর তখন ছিলনা। বাংলার নর-নারীরা যথাক্রমে ধূতি ও শাড়ি পরিধান করত।
পুরুষেরা মালকোচা দিয়ে ধূতি পরত এবং তা হাঁটুর নিচে নামত না। মেয়েদের শাড়ি
গোড়ালী পর্যন্ত পৌঁছাত। মাঝে মাঝে পুরুষেরা গায়ে চাদর, আর মেয়েরা পড়ত ওড়না।
উৎসব-অনুষ্ঠানে বিশেষ পোশাকের ব্যবস্থা ছিল। পুরুষ-নারী উভয়ের মধ্যেই
অলংকার ব্যবহারের রীতি প্রচলিত ছিল। তারা কানে কুণ্ডল, গলায় হার, আঙ্গুলে
আংটি, হাতে বালা ও পায়ে মল পরিধান করত। মেয়েরাই কেবলমাত্র হাতে শঙ্খের বালা
পরত এবং অনেকগুলো চুড়ি পরতে ভালবাসত। মণি-মুক্তা ও দামী সোনা-রূপার অলংকার
ধনীরা ব্যবহার করত। মেয়েরা নানাপ্রকার খোপা বাঁধত। পুরুষদের বাবড়ি চুল
কাঁধের উপর ঝুলে থাকত। কর্পুর, চন্দন প্রভৃতি প্রসাধন সামগ্রীর সহিত
বিভিন্ন সুগন্ধির ব্যবহার তখন খুব প্রচলিত ছিল। মেয়েদের সাজসজ্জায় আলতা,
সিঁদুর ও কুমকুমের ব্যবহারও তখন প্রচলিত ছিল। পুরুষেরা মাঝে মধ্যে কাঠের
খড়ম বা চামড়ার চটিজুতা ব্যবহার করত। তখন ছাতারও প্রচলন ছিল।
তখনকার দিনে নানা রকম খেলাধূলা ও আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল। পাশা ও দাবা
খেলা প্রচলিত ছিল। তবে নাচ- গান ও অভিনয়ের প্রচলন ছিল খুব বেশি। বীণা,
বাঁশি, মৃদঙ্গ, ঢাক, ঢোল, খোল, করতাল ইত্যাদি তো ছিলই, এমনকি মাটির
পাত্রকেও বাদ্যযন্ত্ররূপে ব্যবহার করা হতো। কুস্তি, শিকার, ব্যয়াম,
নৌকাবাইচ ও বাজিকরের খেলা পুরুষদের খুব পছন্দ ছিল। নারীদের মধ্যে উদ্যান
রচনা, জলক্রীড়া ইত্যাদি আমোদ-প্রমোদের প্রচলন ছিল।
অন্নপ্রাশন, বিয়ে, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি সামাজিক আচার-আচরণ অনুষ্ঠান সে যুগেও
প্রচলিত ছিল। বারো মাসে তেরো পার্বণ অনুষ্ঠিত হতো। এ উপলক্ষে নানা প্রকার
আমোদ-উৎসবের ব্যবস্থা ছিল। প্রাচীনকালে বাংলায় বর্তমানকালের ন্যায়
ভ্রাতৃদ্বিতীয়া (ভাইফোঁটা), নবান্ন, রথযাত্রা, অষ্টমী স্নান, হোলি,
জন্মাষ্টমী, দশহরা, অক্ষয় তৃতীয়া, গঙ্গাস্নান প্রভৃতি সুপরিচিত
অনুষ্ঠানগুলো সেকালেও প্রচলিত ছিল। এসকল নানাবিধ আমোদ-উৎসব ছাড়াও
হিন্দুধর্মের অনেক লৌকিক অনুষ্ঠানও প্রাচীনকালের সমাজ জীবনে বিশিষ্ট স্থান
অধিকার করেছিল। শিশুর জন্মের পূর্বে তার মঙ্গলের জন্য গর্ভাধান,
সীমন্তোন্নয়ন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো। জন্মের পর নামকরণ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি
উপাচার পালন করা হতো। প্রাচীনকালে বাংলার জনগণের দৈনন্দিন জীবনে
ধর্মশাস্ত্রের প্রবল প্রভাব ছিল। কোন্ তিথিতে কি কি খাদ্য নিষিদ্ধ, কোন্
তিথিতে উপবাস করতে হবে এবং বিবাহ, শিশু বয়সে পড়াশুনা শুরু করা, বিদেশ
যাত্রা, তীর্থযাত্রা প্রভৃতির জন্য কোন্ কোন্ সময় শুভ বা অশুভ ইত্যাদি
বিষয়ে নিয়ম কঠোরভাবে পালিত হতো।
প্রচীন বাংলার মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন ছিল গরুর গাড়ি ও নৌকা।
খাল-বিলে চলাচলের জন্য ভেলা ও ডোঙ্গা ব্যবহার করত। মানুষ ছোট ছোট খাল পার
হতো সাঁকো দিয়ে। ধনী লোকেরা হাতী, ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ি প্রভৃতি যাতায়াতের জন্য
ব্যবহার করত। তাদের স্ত্রী-পরিজনেরা নৌকা ও পালকীতে একস্থান হতে অন্য
স্থানে আসা-যাওয়া করত। বিবাহের পর নববধূকে গরুর গাড়িতে বা পালকিতে করে
শ্বশুর বাড়ি আনা হত। মোটের উপর মনে হয় যে, আধুনিক কালের গ্রামীণ জীবনযাত্রা
এবং সেকালের জীবনযাত্রার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না।
কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলার অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করত। মানুষের জীবন
মোটের উপর সুখের ছিল। তবে প্রাচীন বাংলার গরিব দুঃখী মানুষের কথাও জানা
যায়। সমাজের উঁচু শ্রেণি অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের হাতে ছিল মূল ক্ষমতা। এ সময়
শুধুমাত্র ব্রাহ্মণরাই শাস্ত্রজ্ঞান চর্চা করতে পারত। ব্রাহ্মণদের অত্যাচার
সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছিল। এ উৎপাত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের
প্রতি অধিক হতো। শেষ দিকের সেন রাজাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত
অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে। সেন বংশের শাসনামলে বৌদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতিতে নেমে আসে
দুর্দশা। ব্রাহ্মণদের প্রভাবে সেনদের সময়ে সাধারণ হিন্দু সমাজ দুর্বল হয়ে
পড়ে। প্রাচীন বাংলার শেষ পর্যায়ে এ বিশৃঙ্খল অবস্থায় মুসলমান সমাজের ভিত
গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মুসলমান সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে বাংলায়
মধ্যযুগের সূচনা হয়। আর এ যুগে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির রূপও পাল্টে যায়।
প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা এবং শিল্পকলা ও স্থাপত্য-ভাস্কর্য
প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা
বাংলা চিরকালই কৃষি প্রধান দেশ। প্রাচীনকালে বাংলার অধিবাসীদের বেশির ভাগ
লোকই গ্রামে বাস করত। তারা সবাই মিলে একসাথে গ্রাম গড়ে তুলত। আর গ্রামের
আশপাশের ভূমি চাষ করে সংসার চালাতো। যারা চাষ করত বা অন্য কোন প্রকারে জমি
ভোগ করত, বিনিময়ে তাদের কতকগুলো নির্দিষ্ট কর দিতে হতো।
প্রধানত: তিন প্রকারের ভূমি ছিল। ঘর-বাড়ি তৈরি করে থাকার জন্য উপযুক্ত
জমিকে ‘বাস্তু’, চাষ করা যায় এমন উর্বর জমিকে ‘ক্ষেত্র’ এবং উর্বর অথচ পতিত
জমিকে বলা হতো ‘খিল’। এ তিন প্রকারের ভূমি ছাড়াও অন্যান্য প্রকারের ভূমি
ছিল। সেগুলো হলো- চারণ ভূমি, হাট-বাজার, অনুর্বর, বনজঙ্গল এবং যানবাহন
চলাচলের পথ। মনে করা হয় এ সময় ভূমির মালিক ছিলেন রাজা নিজে। তখনকার দিনে
‘নল’ দিলে জমি মাপা হতো। বিভিন্ন এলাকায় নলের দৈর্ঘ্য বিভিন্ন রকমের ছিল।
প্রাচীনকাল হতেই বঙ্গদেশ কৃষির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তাই এদেশের অর্থনীতি গড়ে
উঠেছে কৃষির উপর নির্ভর করে। ধান ছিল বাংলার প্রধান ফসল। এছাড়া পাট,
ইক্ষু, তুলা, নীল, সর্ষে ও পান চাষের জন্য বাংলার খ্যাতি ছিল। ফলবান
বৃক্ষের মধ্যে ছিল আম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, ডালিম, কলা, লেবু, ডুমুর,
খেজুর ইত্যাদি। এলাচি, লবঙ্গ প্রভৃতি মসলাও বঙ্গে উৎপন্ন হতো। গৃহপালিত
পশুর মধ্যে গরু, ছাগল, মেষ, হাঁস-মুরগি, কুকুর ইত্যাদি ছিল প্রধান। লবণ ও
শুটকি দেশের কোনো কোনো অংশে উৎপন্ন হতো।
কুটির শিল্পে প্রাচীন বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। গ্রামের লোকদের দরকারি সব
কিছু গ্রামেই তৈরি হতো। মাটির তৈরি জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল কলস, ঘটি-বাটি,
হাঁড়ি-পাতিল, বাসনপত্র ইত্যাদি। লোহার তৈরি জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল দা,
কুড়াল, কোদাল, খন্তা, খুরপি, লাঙ্গল ইত্যাদি। এছাড়া জলের পাত্র, তীর,
বর্শা, তলোয়ার প্রভৃতি যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতো। বিলাসিতার নানা রকম
জিনিসের জন্য স্বর্ণ-শিল্প ও মণি-মানিক্য শিল্প অনেক উন্নতি লাভ করেছিল।
কাঠের শিল্পও সে সময়ে অত্যন্ত উন্নত ছিল। সংসারের আসবাবপত্র, ঘর-বাড়ি,
মন্দির, পাল্কি, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, রথ প্রভৃতি কাঠের দ্বারাই তৈরি
হতো। এছাড়া নদীপথে চলাচলের জন্য নানা প্রকার নৌকা ও সমুদ্রে চলাচলের জন্য
কাঠের বড় বড় নৌকা বা জাহাজ তৈরি হতো।
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান হলেও অতি প্রাচীনকাল হতে এখানে নানা প্রকার শিল্পজাত
দ্রব্য তৈরি হতো। বস্ত্র শিল্পের জন্য বাংলা প্রাচীনকালেই বিখ্যাত হয়ে
উঠেছিল। বিশ্বখ্যাত মসলিন কাপড় প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় তৈরি হতো। এ বস্ত্র
এত সূক্ষ্ম ছিল যে, ২০ গজ মসলিন একটি নস্যের কৌটায় ভরা যেত। কার্পাস তুলা ও
রেশমের তৈরি উন্নতমানের সূক্ষ্ম বস্ত্রের জন্যও বঙ্গ প্রসিদ্ধ ছিল।
কার্পাস তুলা ও শনের তৈরি মোটা কাপড়ও তখন প্রস্তুত হতো। জানা যায় যে,
বঙ্গদেশে সে সময় টিন পাওয়া যেত।
বঙ্গে কৃষি ও শিল্প দ্রব্যের প্রাচুর্য ছিল। আবার এগুলোর খুব চাহিদাও ছিল
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তাই বঙ্গের সঙ্গে
প্রাচীনকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। বঙ্গের রপ্তানী
পণ্যের মধ্যে উলে- যোগ্য ছিল সূতি ও রেশমী কাপড়, চিনি, গুড়, লবণ, তেজপাতা ও
অন্যান্য মসলা, চাউল, নারকেল, সুপারি, ঔষধখ তৈরির গাছপালা, নানা প্রকার
হিরা, মুক্তা, পান্না ইত্যাদি।
শিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যও যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল।
স্থল ও জল উভয় পথেই বাণিজ্যের আদান-প্রদান চলত। দেশের ভেতরে বাণিজ্য ছাড়াও
সে সময়ে বাংলা বৈদেশিক বাণিজ্যে বিশেষ উন্নত ছিল। স্থল ও জলপথে ভারতের
অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাংলার পণ্য বিনিময় চলত। এ কারণে বাংলার বিভিন্ন
স্থানে বড় বড় নগর ও বাণিজ্য বন্দর গড়ে উঠেছিল। এগুলো হলো- নব্যাবশিকা,
কোটীবর্ষ, পুন্ড্রবর্ধন, তাম্রলিপ্ত, কর্ণসুবর্ণ, সপ্তগ্রাম ইত্যাদি। অবশ্য
শহর ছাড়া গ্রামের হাটবাজারেও কিছু কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। এসব গ্রামের
হাটে গ্রামে উৎপন্ন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেচা-কেনা হতো। সমুদ্র পথে
সিংহল, ব্রহ্মদেশ, চম্পা, কম্বোজ, যবদ্বীপ, মালয়, শ্যাম, সুমাত্রা, চীন
প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাংলার পণ্য বিনিময় চলত। স্থলপথে চীন, নেপাল, ভূটান,
তিব্বত ও মধ্য এশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চলত।
শিল্পের উন্নতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বাংলার ধন-সম্পদ ও ঔশ্বর্য
প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল। প্রাচীনকালে হয়ত ক্রয়-বিক্রয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের
জন্য ‘বিনিময় প্রথা’ প্রচলিত ছিল। সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব চার শতকের পূর্বে
বাংলায় মুদ্রার প্রচলন আরম্ভ হয়। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গদেশে বিভিন্ন প্রকার
মুদ্রা চালু থাকলেও এখানে কড়ি সবচেয়ে কম মান হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
শিল্পকলা ও স্থাপত্য-ভাস্কর্য
বাংলাদেশের নানাস্থানে প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের
বহু নির্দশন পাওয়া গেছে। নানাবিধ কারণে প্রাচীন বাংলার শিল্পকলা ধ্বংস হয়ে
গেছে। তবুও নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রাচীন যুগে বাংলার শিল্পকলা খুবই উন্নত
ছিল।
স্থাপত্য : প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন অতি সামান্যই আবিষ্কৃত
হয়েছে। চীন দেশের ভ্রমণকারী ফা-হিয়েন ও হিউয়েন-সাং- এর বিবরণী ও প্রাচীন
শিলালিপি থেকে প্রাচীন যুগে বাংলার কারুকার্যময় বহু হর্ম্য, (চূড়া, শিখা)
মন্দির, স্তূপ ও বিহারের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়।
ভারত উপ-মহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্যের নির্দশন হলো স্তূপ। বৈদিক যুগে
দেহাবশেষ পুঁতে রাখার জন্য শ্মশানের উপর মাটির স্তূপ রক্ষা করার জন্য এ
স্থাপত্য পদ্ধতিকে গ্রহণ করা হয়। বৌদ্ধধর্ম যেখানেই প্রসার লাভ করেছে,
সেখানেই ছোট-বড় অসংখ্য স্তূপ নির্মিত হয়েছে। প্রাচীন বাংলায় কিছু বৌদ্ধ ও
জৈন স্তূপ নির্মিত হয়েছিল। ঢাকা জেলার আশরাফপুর গ্রামে রাজা দেব খড়গের
ব্রোঞ্জ বা অষ্টধাতু নির্মিত একটি স্তূপ পাওয়া গেছে। এটিই সম্ভবত বাংলার
সবচেয়ে প্রাচীন স্তূপের নির্দশন। রাজশাহীর পাহাড়পুর এবং চট্টগ্রামের
ঝেওয়ারিতে আরও দুটি ব্রোঞ্জের তৈরি স্তূপ পাওয়া গেছে। এছাড়া, রাজশাহীর
পাহাড়পুর এবং বাঁকুড়ার বহুলাড়ায় বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইটের তৈরি স্তূপ পাওয়া
গেছে।
অতি প্রাচীনকাল হতে বাংলায় বৌদ্ধ ও জৈন ভিক্ষুরা বিহার ও সংঘরাম তৈরি করে
স্ব স্ব ধর্ম প্রচার করতেন। কিন্তু একে স্থাপত্য কর্ম বলা চলে না। কারণ,
ইট-পাথরের কাঠামোর উপর বাঁশ ও কাঠ দিয়ে এগুলো তৈরি হতো। কালক্রমে বৌদ্ধ ও
জৈন সংঘে যখন প্রচারকের সংখ্যা বাড়তে লাগল তখন হতেই ইটের তৈরি বিহার
প্রস্তুত শুরু হলো। পাল যুগে এসেই বিহারের রূপের পরিবর্তন হলো। এসব বিহারের
কোনো কোনটি বেশ বড় এবং কারুকার্যময় ছিল। স্তূপের মত এগুলোও ধ্বংসপ্রাপ্ত
হয়ে গেছে। রাজশাহীর পাহাড়পুরে যে বিশাল বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে তা
প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এ পর্যন্ত ভারত
উপমহাদেশে যত বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে তারমধ্যে এ বিহারটি সবচেয়ে বড়। জানা
যায়, অষ্টম শতকে ধর্মপাল এখানে প্রকাণ্ড বিহারটি নির্মাণ করেন। ‘সোমপুর
বিহার’ নামে এটি সমগ্র ভারতবর্ষে ও ভারতবর্ষের বাইরে খ্যাতি অর্জন করে।
সোমপুর বিহার ব্যতীত ধর্মপাল বিক্রমশীল বিহার ও ওদন্তপুর বিহার নামে আরও
দুটি বিহার নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া পাল আমলে তৈরি ছোট-বড় আরও কয়েকটি
বিহারে নাম পাওয়া যায়। যেমন-মালদহের ‘জগদুল বিহার’, ‘দেবীকোট বিহার’,
চট্টগ্রামের ‘পণ্ডিত বিহার’, ত্রিপুরার ‘কনকস্তূপ বিহার’ প্রভৃতি। কয়েক বছর
পূর্বে কুমিল-র ময়নামতিতে কয়েকটি বিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে। ইহা ‘শালবল
বিহার’ নামে পরিচিত।া কেহ কেহ মনে করেন যে, পাহাড়পুরের বিহার ও মন্দির
অপেক্ষাও বড় মন্দির ও বিহার এখানে ছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশের স্থাপত্যের ইতিহাসে প্রাচীন বাংলার মন্দির স্থাপনা
মর্যাদা ও স্বকীয়তায় এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কারণ, প্রাচীনকালে এখানে
অসংখ্য মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। এ সকল মন্দির আজ সকলই ধ্বংসপ্রাপ্ত
হয়েছে। কেবলমাত্র অষ্টম শতক হতে কটি ভাঙ্গা ও অর্ধ-ভাঙ্গা মন্দিরের নিদর্শন
পাওয়া যায়। এ সকল বৌদ্ধ মন্দির পুন্ড্রবর্ধন, সমতট, রাঢ়, বরেন্দ্র প্রভৃতি
অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। বর্ধমান জেলার বরাকরের মন্দিরটি প্রাচীন বাংলার
সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশের স্থাপত্য শিল্পের
ইতিহাসে পাহাড়পুরের মন্দির এক অমর সৃষ্টি। এ উপমহাদেশের ইতিহাসে পাহাড়পুরের
মন্দিরের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, উপমহাদেশের অবশিষ্ট অঞ্চলের স্থাপত্য
শিল্পকে ইহা গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। দিনাজপুর জেলার বাণগড়ে প্রস্তর
নির্মিত এবং চট্টগ্রামের কেওয়ারিতে ব্রোঞ্জের তৈরি মন্দির পাওয়া গেছে।
অতি সমপ্রতি ওয়ারী-বটেশ্বর গ্রামে প্রায় ২৫০০ বৎসরের পুরাতন এক
নগর-কেন্দ্রিক ধবংসাবশেষ পাওয়া গেছে। ইহা ঢাকা হতে ৭৫ কিলোমিটার দূরে
নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলায় অবস্থিত। এতদিন ধারণা করা হতো প্রাচীন বাংলার
সভ্যতা গ্রাম-কেন্দ্রিক। কিন্তু এ আবিষ্কারের ফলে এখন জোড়ালো ভাবেই বলা
যায় যে প্রাচীন বাংলায় নগর-কেন্দ্রীক সভ্যতাও গড়ে উঠেছিল।
ভাস্কর্য : খ্রিস্টাব্দের শুরুতে অথবা এর পূর্ব বর্ষ হতে বাংলায়
স্থাপত্য শিল্পের পাশাপাশি ভাস্কর্য শিল্পের চর্চাও হতো। প্রাচীন বাংলায়
বহু মন্দির ছিল। তাই ভাস্কর্য শিল্পকলাও যে উন্নত ছিল তাতে সন্দেহ নেই।
অনেক স্থানে মন্দির ধ্বংস হলেও তার মধ্যের দেবমূর্তি রক্ষিত হয়েছে।
কেবলমাত্র পুস্করণ, তমলুক, মহাস্থান প্রভৃতি অঞ্চলে গুপ্ত-পূর্ব যুগের
কয়েকটি পোড়ামাটির মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।
পাহাড়পুরের মন্দির গাত্রে খোদিত পাথর ও পোড়ামাটির ফলক থেকে বাংলার নিজস্ব
ভাস্কর্য শিল্পের বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। বিষয়বস্তু ও শিল্প কৌশলের
দিক থেকে বিচার করলে পাহাড়পুরের ভাস্কর্য-শিল্পকে লোকশিল্প, অভিজাত শিল্প ও
দুয়ের মাঝামাঝি শিল্প কৌশল-এ তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। পাহাড়পুরের
ভাস্কর্যে রামায়ণ-মহাভারতের অনেক কাহিনী এবং কৃষ্ণলীলার অনেক কথা খোদিত
আছে। এছাড়া, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কথাও এ ভাস্কর্যে রূপ
দেয়া হয়েছে। খোদিত ভাস্কর্য ছাড়াও প্রাচীন বাংলায় পোড়ামাটির শিল্প খুবই
উন্নত ছিল। কুমিল-র ময়নামতি ও লালমাই পাহাড়ে বেশ কিছু পোড়ামাটির ফলক ও
মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রাচীনা কোটিবর্ষ নগরীর ধ্বংসস্তূপেও অনেকগুলো
পোড়ামাটির ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। পণ্ডিতগণ এগুলোকে মৌর্য, শূঙ্গ, কুষাণ,
গুপ্ত ও পাল যুগের বলে অনুমান করেছেন। গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণের
ধ্বংসাবশেষেও কিছু পোড়ামাটির মূর্তি পাওয়া গেছে।
চিত্রশিল্প : পাল যুগের পূর্বেকার কোনো চিত্র আজ পর্যন্ত পাওয়া
যায়নি। কিন্তু প্রাচীনকালেই বাংলায় যে চিত্র অঙ্কনের চর্চা ছিল তাতে কোনো
সন্দেহ নেই। সাধারণত: বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরের দেয়াল সৌন্দর্যময় করার জন্য
চিত্রাঙ্কন করার রীতি প্রচলিত ছিল।
তখনকার দিনে বৌদ্ধ লেখকেরা তালপাত্র অথবা কাগজে তাদের পুস্তকের পাণ্ডুলিপি
তৈরি করতেন। এ সকল পুঁথি চিত্রায়িত করার জন্য লেখক ও শিল্পীরা ছোট ছোট ছবি
আঁকতেন।
রেখার সাহায্যে চিত্রাঙ্কনেও প্রাচীন বাংলার শিল্পীরা যথেষ্ট দক্ষতা
দেখিয়েছেন। রাজা রামপালের রাজত্বকালে রচিত ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’
পুঁথি বাংলার চিত্র শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। রেখার সাহায্যে চিত্রাঙ্কনের
আর একটি দৃষ্টান্ত হল সুন্দরবনে প্রাপ্ত ডোম্মনপালের তাম্রশাসনের অপর পিঠে
উৎকীর্ণ বিষ্ণুর রেখাচিত্র।
প্রাচীন বাংলার শিল্পকলার ক্ষেত্রে পাল যুগ স্মরণীয়। নবম থেকে দ্বাদশ শতক-এ
চার শতক পর্যন্ত এ যুগের শিল্পকে সাধারণত; পাল যুগের শিল্পকলা বলে
আখ্যায়িত করা হয়। কারণ, এ যুগের শিল্পনীতিই পরবর্তী সেন যুগেও অব্যাহত ছিল।
প্রস্তর ও ধাতু নির্মিত দেব-দেবীর মূর্তি এ যুগের শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ
নিদর্শন বলে বিবেচিত হয়। এতে ধর্মভাবের প্রভাবই ছিল বেশি। শাস্ত্রীয়
অনুশাসন অনুসারে দেব-দেবীর মূর্তিগুলো নির্মিত হয়েছিল। তথাপি শিল্পীর
শিল্পকৌশল ও সৌন্দর্যবোধের পরিচয় এতে লক্ষ্য করা যায়। মূর্তি নির্মাণে
সাধারণত অষ্টধাতু ও কালো কষ্টিপাথর ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া স্বর্ণ ও রূপার
ব্যবহারের প্রচলন ছিল।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য : উদ্ভব ও বিকাশ
আর্যদের প্রাচীন বাংলায় আগমনের পূর্বে এখানে নানা জাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর
লোক বসবাস করত। তারা আর্যভাষী হিন্দু ছিল না। কিন্তু তারা যে কোন ভাষায়
কথা বলত তা সঠিকভাবে আজও নির্ণয় করা যায়নি। গোষ্ঠী বিভাগের সঙ্গে মানব
জাতির ভাষা বিভাগের সংমিশ্রণ না ঘটিয়ে একথা বলা যায় যে, বাংলার প্রাচীন
অধিবাসীরা নানা ভাষা-ভাষী লোক ছিল না।
বাংলার প্রাচীনতম অধিবাসীরা সম্ভবত ছিল অস্ট্রিক গোষ্ঠীর অস্ট্রো-এশিয়াটিক
জাতির মানুষ। তারা ব্রহ্মদেশে (মায়ানমার) ও শ্যামদেশের (থাইল্যান্ড) মোন
এবং কম্বোজের হ্মের শাখার মানুষের আত্মীয়। এ জাতীয় মানুষকেই বোধ হয় বলা হতো
‘নিষাদ’ কিংবা ‘নাগ’; আর পরবর্তীকালে ‘কোল-, ‘ভিল- ইত্যাদি। তা হলে অনুমান
করা যেতে পারে যে,’’ তাদের ভাষাও ছিল অস্ট্রিক গোষ্ঠীর মোন, হ্মের শাখার
ভাষার মতোই। অনেকটা এরূপ ভাষায় এখনও কথা বলে বাংলাদেশের পশ্চিমে কোল,
মুন্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, আর বর্তমান আসাম রাজ্যের খাসিয়া
পাহাড়ের বাসিন্দারা। অস্ট্রিক গোষ্ঠী ছাড়াও বাংলায় বাস করত দ্রাবিড়
গোষ্ঠীর বিভিন্ন শাখার লোক। তারা ছিল সুসভ্য জাতির মানুষ। তাদের প্রধান
বাসভূমি এখন দাক্ষিণাত্যে। কিন্তু এক সময় তারা সম্ভবত পশ্চিম-বাংলা ও
মধ্য-বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। অস্ট্রো-এশিয়াটিক ও দ্রাবীড় ভাষার লোকেরা ছাড়াও
পূর্ব ও উত্তর বাংলায় বহু পূর্বকাল হতে নানা সময়ে এসেছিল মঙ্গোলীয় বা ভোট
চীনা গোষ্ঠীর নানা জাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোক। এরা হলো গাড়ো, বড়ো, কোচ,
মেছ, কাছাড়ি, টিপরাই, চাকমা প্রভৃতি। সম্ভবত এদেরই বলা হতো কিরাত জাতি। এরা
ভোটচীনা গোষ্ঠীর নানা ভাষা- উপভাষায় কথা বলত। এর কোনো কোনো শব্দ ও রচনা
পদ্ধতি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত ভাষায় লুকিয়ে আছে এবং এর কিছু কিছু নিদর্শন
ভাষা বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পেরেছেন।
অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনা ভাষাগোষ্ঠীর পর যে নতুন একটি ভাষা গোষ্ঠীর
মানুষ বাংলায় প্রবেশ করে তারা হলো আর্য। আর্যদের ভাষার নাম প্রাচীন বৈদিক
ভাষা। পরবর্তীকালে এ ভাষাকে সংস্কার করা হয়। পুরানো ভাষাকে সংস্কার করা হয়
বলে এ ভাষার নাম হয় সংস্কৃত ভাষা। সম্ভবত বৈদিক যুগের শেষ দিকে তারা বাংলায়
আগমন শুরু করে। আর খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে তারা এদেশে বসতি স্থাপন
শেষ করেছিল। ভারত উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো দীর্ঘদিন ধরে তারা
বাংলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে পাশাপাশি বসবাস করতো। ফলে, ক্ষুদ্র
নৃগোষ্ঠীর অধিবাসীরা
নিজেদের ভাষা ত্যাগ করে সম্পূর্ণভাবে আর্য ভাষা গ্রহণ করে। সুতরাং,
সর্বপ্রাচীন যুগে আর্যগণ যে ভাষা ব্যবহার করত এবং যে ভাষায় বৈদিক গ্রন্থ
রচিত হয়েছিল স্থানভেদে এবং সময়ের পরিবর্তনে এর অনেক পরিবর্তন ঘটে। সংস্কৃত
হতে প্রকৃত এবং প্রাকৃত হতে অপভ্রংশ ভাষার উৎপত্তি হয়। অপভ্রংশ ভাষা হতে
অষ্টম বা নবম শতকে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়। যেমন-
কৃষ্ণ>কাহ্ন>কানু>কানাই।
নয় ও দশ শতকের আগে বাংলা ভাষার রূপ কি ছিল তা জানবার কোন উপায় নেই। তবে এ
শতকগুলোতে বাংলায় সংস্কৃত ছাড়াও দুটো ভাষা প্রচলিত ছিল- এর একটি হলো
শৌরসেনী অপভ্রংশ এবং অন্যটি মাগধী অপভ্রংশের স্থানীয় গৌড়-বঙ্গীয় রূপ- যাকে
বলা যায় প্রাচীনতম বাংলা ভাষা। একই লেখক এ দু ভাষাতেই পদ, দোহা, ও গীত রচনা
করতেন। বাংলা ভাষার এরূপ প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
কর্তৃক নেপাল হতে সংগৃহীত চারটি প্রাচীন বৌদ্ধ পুঁথিতে। এগুলো ‘চর্যাপদ’
নামে পরিচিত। এখন পর্যন্ত মোট ৪৭টি চর্যাপদ পাওয়া গেছে। এ চর্যাপদগুলোর
মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের জন্ম হয়। পরবর্তী যুগে বাংলায় সহজিয়া গান, বাউল গান
ও বৈষ্ণব পদাবলীর উৎপত্তি হয়। সুতরাং, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের
দিক থেকে এ চর্যাপদগুলোর মূল্য অপরিসীম। মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, আট শতক
হতে বারো শতক পর্যন্ত এ পাঁচশত বছরই হলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীন
যুগ।
প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক জীবন, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস
প্রাচীন বাংলার ধর্মীয় অবস্থা
প্রাচীন বাংলায় আর্য ধর্ম প্রতিষ্ঠার পূর্বে কোন্ ধর্ম প্রচলিত ছিল, সে
সম্পর্কে সঠিক কোন কিছু জানা যায় না। কারণ সে সকল আদিম অধিবাসীদের
ধর্ম-কর্মের ইতিহাস হলো জনপদবদ্ধ প্রাচীন বাংলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের
পূজা-অর্চনা, ভয়-ভক্তি, বিশ্বাস ও সংস্কারের ইতিহাস। তখন সমগ্র দেশব্যাপী
ধর্মের প্রকৃতি একই রকম ছিলনা। বরং বর্ণ, শ্রেণি, কৌম, জনপদ ইত্যাদির
বিভিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম-কর্মেও বিভিন্নতা দেখা দিয়েছিল। তদুপরি, তাদের
প্রাচীন ধর্মমত, সংস্কার, পূজা-পদ্ধতি প্রভৃতি রূপান্তরিত হয়ে আর্য ধর্মের
সঙ্গে মিলে গিয়েছে। এখনও বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে নারী জাতির মধ্যে
প্রচলিত বৃক্ষ পূজা, পূজা-পার্বণে আম্র পল- , ধান ছড়া, দুর্বা, কলা,
পান-সুপারি, নারকেল, ঘট, সিঁদুরব প্রভৃতির ব্যবহার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর
লোকদের দান। একইভাবে মনসা পূজা, শ্মশান কালীর পূজা, বণদূর্গাপূজা,
ষষ্টীপূজা প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানেরই পরিচয় বহন
করে। খাসিয়া, মুন্ডা, সাঁওতাল, রাজবংশী, বুনো, শবর প্রভৃতি কৌমের লোকেরা
তাদের আদিম পুরুষদের মতো আজও দেবতার আসনে বসিয়ে গাছ, পাথর, পাহাড়,
পশু-পক্ষী ও ফল-মূলের পূজা করে থাকে। প্রাচীন ভারতের মতো তখনকার দিনে এদেশে
নানা রকমের ধ্বজ পূজাও প্রচলিত ছিল। ধ্বজ পূজা ছিল কৌমের লোকদের নিকট
ঐক্যের প্রতীক।
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক হতেই উপমহাদেশের তিনটি বৃহৎ ধর্ম-বৈদিক, বৌদ্ধ ও
জৈন ধর্মের প্রভাবে বাংলা পতিত হয়। বাংলায় গুপ্ত যুগের পূর্বে অবৈদিক আর্য
ধর্মের কিছুটা বিস্তার ঘটলেও খ্রিষ্টীয় তিন-চার শতক পর্যন্ত এখানে আর্য-
বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির কিছুই প্রসার লাভ করে নি। গুপ্ত আমলের তাম্রশাসন
হতে জানা যায় যে, মধ্যদেশ হতে এসে ব্রাহ্মণেরা বঙ্গদেশের নানা জায়গায় বসতি
স্থাপন করেছিল। তারা বৈদিক যাগ-যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করতেন এবং বেদ আলোচনা
করতেন। তাদের ধর্ম-কর্ম পরিচালনা ও মন্দির নির্মাণের জন্য ভূমিদান করে
রাজা-মহারাজারা পূণ্য অর্জনের চেষ্টা করতেন। এভাবে ছয় শতকে বৈদিক ধর্ম ও
সংস্কৃতির ঢেউ বাংলার পূর্ব সীমানা পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
পাল শাসনের আমলেও বৈদিক ধর্মের প্রভাব প্রতিপত্তি অটুট ছিল। বর্ম ও সেন
রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে একাদশ ও দ্বাদশ শতকে বৈদিক ধর্ম আরও প্রসার লাভ
করে। এ দুই বংশের রাজা-মহারাজারা প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মে বিশ্বাসী
ছিলেন। তখন বৌদ্ধ ধর্ম অনেকটা ম-ন হয়ে গিয়েছিল। বৈদিক যাগ-যজ্ঞে পৌরাণিক
দেব-দেবী ও বিশেষ বিশেষ তিথিা নক্ষত্রে স্নান-দান-ধ্যান-ক্রিয়াকর্মের
প্রচলন শুরু হয়। জাতকর্ম, নিষ্ক্রমণ, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়ান্তকরণ,
উপনয়ন, সমাবর্তন, বিবাহ, গৃহ প্রবেশ ইত্যাদি সংস্কার এভাবে বাঙালি
ব্রাহ্মণ্য সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এসব সংস্কার দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য
ব্রাহ্মণরা সরাসরি রাষ্ট্রের সহায়তা লাভ করেছিল।
বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বাংলার বুকে খুব দ্রুত প্রসার লাভ করলেও কালক্রমে
এর মধ্যে বিবর্তন দেখা দেয়। গুপ্ত আমলে এদেশে একটি নতুন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের
আবির্ভাব ঘটে। বৈদিক যুগের দেব-দেবীর পরিচয় প্রায় বিলীন হয়ে যায়। তার
পরিবর্তে নতুন নতুন দেব-দেবীর পূজা শুরু হয়। এ সকল দেবতাদের নামের সঙ্গে
বৈদিক দেবতার নামের মিল ছিল। কিন্তু বৈদিক ক্রিয়াকান্ডের সঙ্গে তাদের কোনো
মিল ছিল না। এ নতুন দেব-দেবীরা ছিলেন মূলত পুরাণ ও মহাকাব্যে বর্ণিত
দেব-দেবী। তাই এ ধর্মকে ‘পৌরাণিক ধর্ম’ বলা হয়। স্থানীয় ধর্ম বিশ্বাসের
প্রভাবের ফলে আর্য ধর্মে এরূপ বিবর্তন দেখা দেয়। পুরোহিতরা ধর্ম-কর্ম
পরিচালনা করার সার্বিক দায়িত্ব লাভ করেন। ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ডের জটিলতা বেড়ে
যায়। দেবতার বেদিতে দুধ ও ঘৃত উৎসর্গের পরিবর্তে পশুবলি প্রথা বৃদ্ধি পায়।
বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কার ধর্মের অঙ্গ হিসেবে দেখা দেয়।
পাল পর্বে যে পৌরাণিক ধর্ম ও সংস্কারের বিস্তার দেখা যায়, সেন আমলে তা আরও
প্রসারিত হয়। সূর্য গ্রহণ, চন্দ্র গ্রহণ, উত্থান দ্বাদশী তিথি, উত্তরায়ন,
সংক্রান্তি ইত্যাদি উপলক্ষে স্নান, তর্পণ ও পূজা, সুখরাত্রি ব্রত, হোলাকা
বা বর্তমান কালের হোলি উৎসব, জন্মাষ্টমী, নীতি পাঠের অনুষ্ঠান প্রভৃতি
পৌরাণিক ক্রিয়া-কলাপ এ যুগে ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
পৌরাণিক পূজা পার্বণের রীতি-নীতি ও ক্রিয়াকলাপ হতে যে সকল ধর্ম সমপ্রদায়ের
উদ্ভব হয় তাদের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা সর্বাপেক্ষা উলে- যোগ্য।
পাল-চন্দ্র-কম্বোজ যুগে বৈষ্ণব ধর্মের উন্নতির প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্নখ
লিপিমালায়। পাল রাজাদের অনেকে বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠাপোষক হলেও অন্য ধর্মের
ন্যায় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু সেন রাজাদের অবস্থা
ভিন্নতর। যদিও পূর্বপুরুষেরা সদাশিবের পূজা করতেন, তবু রাজা লক্ষণ সেন
ছিলেন ‘পরমবৈষ্ণব’। তাঁর সময় হতেই রাজকীয় শাসনের শুরুতে শিবের পরিবর্তে
বিষ্ণুর স্তবের প্রচলন হয়।
গুপ্তযুগে শৈব ধর্মও প্রচলিত ছিল। ষষ্ঠ শতকের গোঁড়ায় মহারাজ বৈন্যগুপ্তের
সহায়তায় পূর্ব বাংলায় শৈবধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল। সপ্তম শতকে গৌড়রাজ শশাংক ও
কামরূপ রাজা ভাস্কর-বর্মা-দুজনেই ছিলেন পরম শৈব। লক্ষণ সেন ও তাঁর বংশধরগণ
বৈষ্ণব মতাবলম্বী হলেও কুলদেবতা সদাশিবকে কখনও পরিত্যাগ করেননি। আর্যাবর্তে
পাশুপত ধর্মাবলম্বীরা সবচেয়ে প্রাচীন শৈব সমপ্রদায়। পাল আমলে পাশুপত
সমপ্রদায়ও খুব শক্তিশালী ছিল।
এসকল দেব-দেবীর পূজা ব্যতীত অন্যান্য আরও অনেক পৌরাণিক দেব-দেবীর পূজা
বাংলায় প্রচলিত ছিল। এদের মধ্যে সূর্য ও শক্তি পূজাই ছিল সর্বাপেক্ষা উলে-
যোগ্য।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জৈন ধর্মের প্রবর্তক বর্ধমান মহাবীর রাঢ় দেশে আগমন
করেছিলেন। কিন্তু সেখানকার লোকেরা তাঁর ধর্মকে গ্রহণ করেনি। বরং তাঁর সহিত
দুর্ব্যবহার করেছিল। তাই বলে জৈন ধর্মের অগ্রগতি রোধ করা যায়নি। প্রাচীনকাল
হতে এ সমপ্রদায়ের লোকেরা ‘নিগ্রহন্ত’ নামে পরিচিত হতো। গুপ্তযুগ পর্যন্ত এ
নাম বর্ধমান মহাবীরপ্রচলিত ছিল। সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে উত্তর বঙ্গে জৈন
সমপ্রদায় বিদ্যমান ছিল। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে নাটোরের পাহাড়পুড়ে একটি জৈন
বিহার ছিল। সপ্তম শতকে উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব
বঙ্গে নিগ্রহন্ত জৈনদের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। সমতট ও পুন্ড্রবর্ধনে
তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তেরো শতকেও বাংলায় জৈন বা ‘নিগ্রহন্ত’ সংঘের
রীতিমতো অস্তিত্ব ছিল। তবে পাল যুগ শুরু হবার পর হতে জৈন ধর্মের প্রভাব কমে
এসেছিল।
প্রাচীন বাংলার ধর্ম জগতে বৌদ্ধ ধর্ম একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।
বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর বাংলার কোথাও কোথাও বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল। অশোকের
রাজত্বকালেই বৌদ্ধ ধর্ম বাংলায় বেশি প্রসার লাভ করে। গুপ্ত ও গুপ্ত
পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ না করলেও এর খুব তোড়জোড় ছিল। ষষ্ঠ
শতকের গোঁড়ার দিকে বাংলার পূর্বতম প্রান্ত ত্রিপুরায় মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম
সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কুমিল- অঞ্চলে তখন অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার ছিল। পাল বংশের
আগমনেরা ফলে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব খুব বৃদ্ধি পেয়েছিল। অষ্টম শতক
হতে একাদশ শতক পর্যন্ত বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মেরই জয়জয়কার ছিল। সুদীর্ঘ চারশত
বছরের রাজত্বকালে তাঁদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা-বিহার ছাড়িয়ে এ ধর্ম
আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তাঁরা অনেক বৌদ্ধ-বিহার
নির্মাণ করেছিলেন।
এদের মধ্যে ধর্মপালের বিক্রমশীল মহাবিহার, সোমপুর বিহার ও ওদন্তপুর বিহার
সর্বাপেক্ষা উলে- যোগ্য। এ সকলখ বিহারে তিব্বত ও অন্যান্য অঞ্চল হতে অনেকে
বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্য আগমন করতেন। সোমপুর বিহারে বাস করতেন
মহাপণ্ডিতাচার্য বোধিভদ্র। আচার্য অতীশ দীপঙ্করও কিছুকাল এ বিহারে বাস
করেছিলেন। বাংলা ছাড়াও রাঢ় অঞ্চল, বরেন্দ্র, দিনাজপুর, ত্রিপুরা, কুমিল- ও
চট্টগ্রামেও ছোট-বড় অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার ছিল। কয়েক বছর পূর্বো কুমিল-র
ময়নামতিতে কিছু সংখ্যক বিহারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে অত্যন্ত
বিশাল আকৃতির বিহারটিা ‘শালবন বিহার’ নামে পরিচিত। শ্রীভবদের ইহা নির্মাণ
করেছিলেন। পাল যুগের পর বাংলায় বৌদ্ধধর্ম সহজিয়া ধর্মরূপে জনপ্রিয় হয়ে
উঠেছিল। সমাজের নিম্ন স্তরে সহজিয়া ধর্মের খুব প্রভাব ছিল।
পাল রাজাদের মতো চন্দ্র বংশ ও কান্তিদেবের বংশের লোকেরাও বৌদ্ধ ছিলেন।
কিন্তু সেন রাজাগণের আগমনের পর বাংলায় শৈব ও বৈষ্ণব ধর্ম এবং প্রাচীন বৈদিক
ও পৌরাণিক ধর্মানুষ্ঠান ও আচার-ব্যবহার পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হয়।
সেন যুগেই বিষ্ণু, শিব, পার্বতী প্রভৃতি দেব-দেবীর পূজা শুরু হয় এবং বহু
হিন্দু মন্দির নির্মিত হয়। ফলে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের পতন শুরু হয়। তারপর শেষ
আঘাত আসে তুর্কী মুসলমানদের নিকট হতে। দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে তুর্কী
আক্রমণের ফলে যখন প্রথমে মগধ ও পরে উত্তর বাংলার বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরগুলো
ধ্বংস হয়, তখনই বৌদ্ধসংঘ ভারতের পূর্বপ্রান্তের এ সর্বশেষ আশ্রয় স্থান হতে
বিতাড়িত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য নেপাল ও তিব্বতে গমন করে। বৌদ্ধসংঘই ছিল বৌদ্ধ
ধর্মের প্রধান কেন্দ্র। কাজেই বৌদ্ধ সংঘের সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মও বাংলা
তথা ভারতবর্ষ হতে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
প্রাচীন বাংলায় বৈদিক, পৌরাণিক, জৈন, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী
সমপ্রদায় বর্তমান থাকলেও এদের মধ্যে কলহ ও হিংসা-দ্বেষ ছিল না। তারা পরস্পর
মিলেমিশে পাশাপাশি বসবাস করত। বিশেষ করে পালরাজগণ বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক
হয়েও অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। প্রাচীন বাংলায় একমাত্র
শশাংকের পরধর্ম বিদ্বেষের কাহিনী আছে। অবশ্য এর সত্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট
সন্দেহ আছে। চীনা এবং তিব্বতীয় তথ্য হতে জানা যায় যে, প্রাচীন যুগে বাংলার
ধর্ম জীবন খুব উন্নত ছিল এবং পরধর্ম সহিষ্ণুতা বাঙালি চরিত্রের অন্যতম
বৈশিষ্ট্য ছিল।
প্রাচীন বাংলার আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব ও রীতি-নীতি
প্রাচীন বাংলায় পূজা-পার্বন ও আমোদ প্রমোদের প্রচুর ব্যবস্থা ছিল। উমা
অর্থাৎ দূর্গার অর্চনা উপলক্ষে বরেন্দ্রে বিপুল উৎসব হতো। বিজয়া দশমীর দিন
‘শাবোরৎসব’ নামে একপ্রকার নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান হতো।
চৈত্র মাসে বাদ্য সহকারে এক ধরনের অশ-ল গানের রীতি তখন প্রচলিত ছিল। হোলাকা
বা বর্তমান কালের ‘হোলি’ী একটি প্রধান উৎসব ছিল। স্ত্রী-পুরুষ সকলে এতে
যোগদান করতো। কোজাগরী পূর্ণিমা রাত্রিতে অক্ষ-ক্রীড়া হতো। আত্মীয়-স্বজন
মিলে চিড়া ও নারকেলের প্রস্তুত নানাবিধ খাদ্য গ্রহণ সে রাত্রির প্রধান অঙ্গ
ছিল। দ্যুত-পতিপদ নামে একটি বিশেষ উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদে
অনুষ্ঠিত হতো। এ মাসেই সুখরাত্রিব্রত পালিত হতো। ভ্রাতৃদ্বিতীয়া,
আকাশপ্রদীপ, জন্মাষ্টমী, অক্ষয় তৃতীয়া, দশহরা, গঙ্গাস্নান, মহাঅষ্টমীতে
ব্রহ্মপুত্র স্নান ইত্যাদি বর্তমানের সুপরিচিত অনুষ্ঠানগুলো সেকালেও
প্রচলিত ছিল।
এ সকল পূজা-পার্বণে অনুষ্ঠিত নানাবিধ আমোদ-উৎসব ব্যতীত হিন্দুধর্মের অনেক
লৌকিক অনুষ্ঠানও প্রাচীনকালের সামাজিক জীবনে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল।
শিশুর জন্মের পূর্বে তার মঙ্গলের জন্য গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন ও
শোষ্যন্তীহোম অনুষ্ঠিত হতো। জন্মের পর জাতকর্ম, নিষ্ক্রমণ, নামকরণ,
পৌষ্টিককর্ম, অন্নপ্রাশন ও আরও অনেক উপাচার পালন করা হতো।
বাংলার হিন্দুদের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মশাস্ত্রের প্রবল প্রভাব ছিল। কোন্
তিথিতে কি কি খাদ্য ও কর্ম নিষিদ্ধ, কোন্ তিথিতে উপবাস করতে হবে এবং
বিবাহ, অধ্যয়ন, বিদেশ যাত্রা, তীর্থ গমন প্রভৃতির জন্য কোন্ কোন্ কাল শুভ
বা অশুভ সে বিষয়ে শাস্ত্রের অনুশাসন কঠোরভাবে পালিত হতো।
তখনকার দিনে বাঙালি পুরুষদের কোনো সুনাম ছিল না। বরং তারা বিবাদপ্রিয় ও
উদ্ধত বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু বাঙালি মেয়েদের সুখ্যাতি ছিল। মেয়েরা
লেখাপড়াও শিখত। শিক্ষিত সমাজে মাতা ও পত্নীর সম্মান ও মর্যাদা বেশ উচ্চ
ছিল। সে যুগে অবরোধ বা পর্দা প্রথা ছিল না। বাংলার মেয়েদের কোনো
স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা ছিল না। একটি মাত্র স্ত্রী গ্রহণই ছিল সাধারণ
নিয়ম। তবে পুরুষের মধ্যে বহু বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। অনেক স্ত্রীকেই
সপত্নীর সঙ্গে একত্রে জীবন যাপন করতে হত। বিধবা নারী জীবনের চরম অভিশাপ বলে
বিবেচিত হত। মুছে যেত কপালের সিঁদুর এবং সেই সঙ্গে তার সমস্ত প্রসাধন ও
অলঙ্কার। বিধবাকে নিরামিষ আহার করে সব ধরনের বিলাস বর্জন ও কৃচ্ছ্র সাধন
করতে হতো। সহমরণ প্রথা সেকালেও প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যু হলে একই
চিতায় স্ত্রীকেও জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। প্রাচীন বাংলায় ধন-সম্পত্তিতে
নারীদের কোনো বিধিবিধানগত অধিকার ছিল না। তবে, স্বামীর অবর্তমানে অপুত্রক
বিধবা স্ত্রী স্বামীর সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দাবি করতে পারত।
বাংলার প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে নৈতিক জীবনের খুব উচ্চ আদর্শের পরিচয় পাওয়া
যায়। একদিকে সত্য, শৌচ, দয়া, দান প্রভৃতি সর্ববিধ গুণের মহিমা কীর্তন করা
হয়েছে। অপরদিকে, ব্রহ্ম হত্যা, সুরা পান, চুরি করা, পরদার গমন (পরস্ত্রীর
নিকট গমন) প্রভৃতি মহাপাতক বলে গণ্য করে তার জন্য কঠোর শাস্তি ও গুরুতর
প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে এ আদর্শ কি পরিমাণে
অনুসরণ করা হতো তা বলা কঠিন। তবে সমাজ জীবনে কিছু কিছু দুর্নীতি ও অশ-লতার
প্রমাণ পাওয়া যায়।
এই ব্লগের লেখাসমূহ সরাসরি বোর্ড বই থেকে উদ্ধৃত এবং Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivatives 4.0 International License এর আওতায় প্রকাশিত।
এই ব্লগের লেখাসমূহ সরাসরি বোর্ড বই থেকে উদ্ধৃত এবং Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivatives 4.0 International License এর আওতায় প্রকাশিত।
No comments:
Post a Comment