উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রস্তর যুগ(৭০,০০০-৩৩০০খ্রীষ্টপূর্ব)
দক্ষিণ এশীয় প্রস্তর যুগ দক্ষিণ এশিয়ায় প্যালিওলিথিক, মেসোলিথিক ও
নিওলিথিক পর্য জুড়ে বিদ্যমান ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম
শারীরবৃত্তীয়ভাবে আধুনিক হোমো সেপিয়েন্স-এর প্রমাণ পাওয়া যায়
শ্রীলঙ্কার বাটাডোমবালেনা ও বেলিলেনা গুহাক্ষেত্রে। অধুনা পশ্চিম
পাকিস্তানের মেহেরগড়ে নিওলিথিক পর্ব শুরু হয় ৭০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এবং
শেষ হয় ৩৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ব্রোঞ্জ যুগের সূচনাপর্বে। দক্ষিণ ভারতে
মেসোলিথক পর্ব ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এখানে নিওলিথিক
পর্ব স্থায়ী হয়েছিল ১৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। এরপর ব্রোঞ্জ যুগকে
এড়িয়েই এখানে মেগালিথিক অন্তর্বর্তী পর্ব শুরু হয়ে যায়। উত্তর ও দক্ষিণ
ভারতে যথাক্রমে ১২০০ ও ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ লৌহযুগ শুরু হয়েছিল।
মেহেরগড়(৭০০০-৩৩০০খ্রীষ্টপূর্ব)
মেহেরগড় ৭০০০খ্রীষ্টপূর্ব থেকে ৩২০০ খ্রীষ্টপূর্ব আবিস্কৃত হয়েছে।
মেহেরগড় সভ্যতাঃ মেহেরগড় সভ্যতা ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজ
এবং রিচার্ড মিডৌ আবিস্কার করেন। এখন এর বর্তমান অবস্থান পাকিস্থানে।
সিন্ধু সভ্যতা(৩৩০০-১৭০০খ্রীষ্টপূর্ব)
সিন্ধু সভ্যতা ছিল একটি ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা (৩৩০০ – ১৩০০
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ; পূর্ণবর্ধিত কাল ২৬০০ – ১৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। এই
সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সিন্ধু
নদ অববাহিকা। প্রথম দিকে এই সভ্যতা পাঞ্জাব অঞ্চলের সিন্ধু অববাহিকায়
বিকাশ লাভ করে। পরে তা প্রসারিত হয় ঘগ্গর-ভাকরা নদী উপত্যকা ও গঙ্গা-যমুনা
দোয়াব অঞ্চল পর্যন্ত। বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ,
ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পশ্চিমদিকের রাজ্যগুলি, দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তান
এবং ইরানের বালোচিস্তান প্রদেশের পূর্ব অংশ এই সভ্যতার অন্তর্গত ছিল।
পূর্ণবর্ধিত সময়কালে এই সভ্যতা হড়প্পা সভ্যতা নামে পরিচিত। হড়প্পা ছিল
এই সভ্যতার প্রথম আবিষ্কৃত শহরগুলির অন্যতম। ১৯২০-এর দশকে তদনীন্তন ব্রিটিশ
ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে এই শহরটি আবিষ্কৃত
হয়। ১৯২০ সাল থেকে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নস্থলগুলিতে খননকার্য চলছে। ১৯৯৯
সালেও এই সভ্যতার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসামগ্রী ও আবিষ্কৃত
হয়েছে। মহেঞ্জোদাড়ো সিন্ধু সভ্যতার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
হড়প্পা ভাষা প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণিত হয়নি এবং এই ভাষার উৎস অজ্ঞাত। যদিও
ইরাবতম মহাদেবন, অস্কো পারপোলা, এফ জি বি কুইপার ও মাইকেল উইটজেল প্রমুখ
বিশেষজ্ঞেরা এই ভাষার সঙ্গে প্রোটো-দ্রাবিড়ীয়, এলামো-দ্রাবিড়ীয় বা
প্যারা-মুন্ডা সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী
স্থান।
লৌহ যুগ(১২০০-৩০০খ্রীষ্টপূর্ব)
প্রাগৈতিহাসিক যুগের যে সময়কালে কোন এলাকার ধাতব অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি মূলত
লোহা দ্বারা তৈরি হত সেই সময়কালকে প্রত্নতত্ববিদ্যায় লৌহযুগ বলা হয়।
লোহার ব্যবহার শুরুর সাথে সাথে মানবসমাজে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, যার
মধ্যে কৃষিব্যবস্থা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং শিল্পকলা অন্যতম।
প্রত্নতত্ববিদ্যায় প্রাগৈতিহাসিক যুগকে যে তিনভাগে ভাগ করা হয়, লৌহ যুগ
হচ্ছে সেই তিন যুগের সর্বশেষ যুগ। প্রস্তর যুগ ও ব্রোঞ্জ যুগের পরে লৌহ
যুগের আবির্ভাব। লৌহযুগের সময়কাল ও বৈশিষ্ট্য অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন। সব
অঞ্চলেই লৌহযুগ শেষে ঐতিহাসিক যুগের আবির্ভাব, যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল
লিখিত সংরক্ষিত ইতিহাস। উদাহরণ স্বরুপ, ব্রিটেন এর লৌহযুগ শেষ হয় রোমান
বিজয় এর মাধ্যমে, যার পর হতে ব্রিটেন এর লিখিত ইতিহাস সংরক্ষণ শুরু হয়।
মহাজনপদ(৭০০-৩০০খ্রীষ্টপূর্ব)
মহাজনপদ-এর আভিধানিক অর্থ "বিশাল সাম্রাজ্য" (সংস্কৃত "महा"-মহা =
বিশাল।বৃহৎ, "जनपद"-জনপদ = মনুষ্যবসতি = দেশ)। বৌদ্ধ গ্রন্থে বেশ কয়েকবার
এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বৌদ্ধ গ্রন্থ অঙ্গুত্তরা নিকায়া, মহাবস্তুতে ১৬টি
মহাজনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারের পূর্বে ভারতের
উত্তর-উত্তর পশ্চিমাংশে উত্থিত এবং বিস্তৃত হয়।
প্রাচীন ইন্দো-আর্য্য রাজনৈতিক গঠনের সূত্রপাত হতে শুরু করে জন
(অর্থ-প্রজা।ব্যক্তি:উচ্চারণ-জনো) নামীয় অর্ধ যাযাবর গোত্রসমূহের মাধ্যমে।
প্রাচীন বৈদিক পুস্তকসমূহে আর্যদের বিভিন্ন জন বা গোত্রের কথা পাওয়া
যায়, যারা অর্ধযাযাবর গোত্রীয় কাঠামোতে বসবাস করত এবং নিজেদের ও অন্যান্য
অনার্যদের সাথে গরু, ভেড়া ও সবুজ তৃণভূমি নিয়ে মারামারি করত। এই
সূচনালগ্নের বৈদিক ঽজনঽ নিয়েই মহাকাব্যীয় যুগের জনপদ গঠিত হয়।
মগধ সাম্রাজ্য(৫৪৫খ্রীষ্টপূর্ব)
মগধ সাম্রাজ্য বলতে মগধ অঞ্চলের নিম্নলিখিত সাম্রাজ্যকে বোঝানো হয়।
হর্য্যঙ্ক সাম্রাজ্য (৬৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ৪১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
শিশুনাগ সাম্রাজ্য (৪১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
নন্দ সাম্রাজ্য (৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
মৌর্য সাম্রাজ্য (৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
শুঙ্গ সাম্রাজ্য (১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ– ৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
গুপ্ত সাম্রাজ্য (৩২০ খ্রিস্টাব্দ - ষষ্ঠ শতাব্দী)
মৌর্য্য সাম্রাজ্য(৩২১-১৮৪খ্রীষ্টপূর্ব)
মৌর্য্য সাম্রাজ্য (সংস্কৃত: मौर्यसाम्राज्यम्) প্রাচীন ভারতে লৌহ যুগের
একটি বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য ছিল। মৌর্য্য রাজবংশ দ্বারা শাসিত এই সাম্রাজ্য
৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। ভারতীয়
উপমহাদেশের পূর্বদিকে সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমতলভূমিতে অবস্থিত মগধকে কেন্দ্র
করে গড়ে ওঠা এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র।
মৌর্য্য সাম্রাজ্য তৎকালীন যুগের অন্ততম বৃহত্তম সাম্রাজ্য হিসেবে পরিগণিত
হত, শুধু তাই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় সাম্রাজ্য কখনো
তৈরী হয়নি। ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য নন্দ রাজবংশ
উচ্ছেদ করে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং তারপর মহান আলেকজান্ডারের
সেনাবাহিনীর পশ্চাৎ অপসারণের সুযোগে নিজ সামরিক শক্তিবলে মধ্য ও পশ্চিম
ভারতের আঞ্চলিক রাজ্যগুলিকে জয় করে বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। ৩১৬
খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই গ্রীক সত্রপগুলিকে পরাজিত করে মৌর্য্য সাম্রাজ্য
সম্পূর্ণ উত্তর-পশ্চিম ভারত জুড়ে বিস্তৃত হয়। বর্তমান যুগের মানচিত্রের
নিরিখে এই সাম্রাজ্য উত্তরে হিমালয়, পূর্বে অসম, পশ্চিমে বালুচিস্তান ও
হিন্দুকুশ পর্বতমালা পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য ও
বিন্দুসার এই সাম্রাজ্যকে দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃত করেন এবং অশোক কলিঙ্গ রাজ্য
জয় করে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন।
অশোকের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই সাম্রাজ্যের
পতন ঘটে মগধে শুঙ্গ রাজবংশের উত্থান ঘটে।
ভারতের আদি মধ্যযুগীয় রাজ্যসমূহ
ভারতের আদি মধ্যযুগীয় রাজ্যসমূহ বলতে বোঝায় খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়
শতাব্দীতে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতে উদ্ভূত রাজনৈতিক শক্তিগুলিকে।
২৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সিমুক কর্তৃক সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠার মধ্য
দিয়ে ভারতে আদি মধ্যযুগীয় রাজন্যবর্গের শাসনের সূত্রপাত ঘটে। এই যুগ
ভারতের ধ্রুপদি যুগ নামে পরিচিত। এই যুগে বিশ্বের সামগ্রিক অর্থসম্পদের এক
তৃতীয়াংশ থেকে এক চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সমগ্র প্রাচীন ও
মধ্যযুগীয় বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে ভারত। এই
"আদি মধ্যযুগ" মোটামুটি ১,৫০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ
শতাব্দীতে উত্তর ভারতে মুসলিম সালতানাতগুলির উত্থান (১২০৬ সালে দিল্লি
সুলতানির প্রতিষ্ঠা) এবং দক্ষিণ ভারতে চালুক্য চোল রাজ্যের পতনের (১২৭৯
সালে তৃতীয় রাজেন্দ্র চোলের মৃত্যু) সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আদি মধ্যযুগীয়
রাজন্যবর্গের শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
চোল সাম্রাজ্য(২৫০খ্রীষ্টপূর্ব)
চোল রাজবংশ ছিল একটি তামিল রাজবংশ। দক্ষিণ ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে এই
সাম্রাজ্যই ছিল সর্বাপেক্ষা দীর্ঘকালীন সাম্রাজ্য। চোল রাজবংশের প্রথম
নথিভুক্ত উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে লিখিত সম্রাট
অশোকের শিলালিপিতে। বিভিন্ন অঞ্চলে এই রাজবংশের শাসন খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ
শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।
চোল রাজ্যের মূল কেন্দ্র ছিল কাবেরী নদীর উর্বর উপত্যকা। কিন্তু খ্রিষ্টীয়
নবম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ
পর্যন্ত স্থায়ী চোল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে এই সাম্রাজ্য আরও বড়ো অঞ্চলে
প্রসারিত হয়েছিল। দুই শতাব্দীরও অধিক সময় তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণাঞ্চলে
অবস্থিত দাক্ষিণাত্যের সকল অঞ্চল এই সাম্রাজ্যের অধীনে এসে ঐক্যবদ্ধ
হয়েছিল। প্রথম রাজরাজ চোল ও তাঁর পুত্র প্রথম রাজেন্দ্র চোলের শাসনকালে
চোল সাম্রাজ্য দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম প্রধান সামরিক,
অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিতে পরিণত হয়। সম্রাট প্রথম রাজেন্দ্র চোল
গঙ্গাতীরবর্তী অঞ্চলগুলি অধিকার করার উদ্দেশ্যে সৈন্য অভিযান প্রেরণ করলে,
পূর্বভারতের কিয়দংশ চোল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়াও রাজেন্দ্র
চোল এক প্রবল নৌযুদ্ধের পর শ্রীবিজয়ের সামুদ্রিক সাম্রাজ্য উৎখাত সাধন
করেন এবং একাধিকবার চীনা আক্রমণ প্রতিহত করেন। ১০১০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দের
মধ্যবর্তী সময়ে দক্ষিণে মালদ্বীপ থেকে উত্তরে বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশ
রাজ্যের গোদাবরী নদী অববাহিকা পর্যন্ত চোল সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। রাজরাজ
চোল উপদ্বীপীয় দক্ষিণ ভারত জয় করেন, বর্তমান শ্রীলঙ্কা ভূখণ্ডের কিছু অংশ
অধিকার করেন এবং মালদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ নিজ অধিকারে আনেন। প্রথম রাজেন্দ্র
চোল উত্তর ভারতে সেনা অভিযান প্রেরণ করেন। তিনি পাটলিপুত্রের পাল সম্রাট
মহীপালকে পরাজিত করে গঙ্গা নদীর অববাহিকা পর্যন্ত পাল সাম্রাজ্য প্রসারিত
করেন। এছাড়া মালয় দ্বীপপুঞ্জের রাজ্যগুলির বিরুদ্ধেও তিনি সফলভাবে যুদ্ধে
অবতীর্ণ হন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পাণ্ড্য রাজ্যের উত্থান ঘটলে
চোল সাম্রাজ্য পতনের পথে অগ্রসর হতে থাকে। পাণ্ড্য রাজ্যই চোলদের পতনের
প্রধান কারণ হয়।
চোল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার ছিল সুদূরপ্রসারী। তাঁরা তামিল সাহিত্যের
পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তামিল সাহিত্য ও স্থাপত্যের কিছু মহান নিদর্শন তাঁদেরই
পৃষ্ঠপোষকতায় সৃজিত হয়েছে। চোল রাজারা একাধিক মন্দির ও স্থাপনা নির্মাণ
করেন। এই মন্দিরগুলি কেবলমাত্র ধর্মোপাসনার স্থানই ছিল না, বরং এক একটি
প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠেছিল। তাঁরা ছিলেন একটি
কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থার পথপ্রদর্শক এবং একটি নিয়মতান্ত্রিক
আমলাতন্ত্রের উদ্ভাবক।
সাতবাহন সাম্রাজ্য(২৩০খ্রীষ্টপূর্ব)
সাতবাহন সাম্রাজ্য একটি প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্য যা খ্রিস্টপূর্ব
দ্বিতীয় শতক থেকে পরবর্তী সাড়ে চারশত বছর ধরে দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃত ছিল।
মৌর্য্য সাম্রাজ্যের সামন্ত রাজ্য হিসেবে সাতবাহনরা গণ্য হলেও মৌর্য্য
সাম্রাজ্যের পতনের পর শুঙ্গ ও কাণ্ব রাজবংশের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন
রাজ্য হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। পরবর্তীকালে তাঁরা পশ্চিমী ক্ষত্রপ
রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
কুষাণ সাম্রাজ্য(৬০-২৪০ খ্রীষ্টাব্দ)
খ্রিষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর প্রথমার্ধে শুংনু নামে এক উপজাতি তাদের
প্রতিবেশী ইউয়েচি নামে অপর এক উপজাতিকে হারিয়ে দেয়। দীর্ঘ সংঘর্ষের পর
য়ুঝি উপজাতির লোকেরা পশ্চিমদিকে সরে যেতে বাধ্য হয়। তারা পশ্চিমদিকে সরে
ইলি নদীর উপত্যকা পেরিয়ে ইস্সিক কুল হ্রদের দক্ষিণতীর ধরে এগোতে থাকে।
তাদের এই স্থান পরিবর্তন শকসহ বেশ কিছু উপজাতিকে তাদের সামনে এগোতে বাধ্য
করে। ১৪৫-১২৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী কোন সময়ে তারা ব্যাকট্রিয় ও
পার্থিয়ায় বসতি স্থাপন করে। এক প্রজন্ম পর তারা সেই জায়গা ত্যাগ করে
কাবুল উপত্যকা পেরিয়ে পাঞ্জাব সমভূমিতে প্রবেশ করে। খ্রীষ্টাব্দ শুরুর
দিকে য়ুঝি উপজাতির নেতা কিউ-সিউ-কিও বাকী চার নেতাকে মেরে সমগ্র উপজাতির
প্রধান হয়ে বসে। তার নাম থেকেই নাম হয় কিউই-শাং বা কুষাণ।
গুপ্ত সাম্রাজ্য(২৮০-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ)
গুপ্ত সাম্রাজ্য ছিল একটি প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্য। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ৩২০ থেকে ৫৫০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে এই সাম্রাজ্য প্রসারিত ছিল। মহারাজ শ্রীগুপ্ত ধ্রুপদি সভ্যতা-র আদর্শে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। গুপ্ত শাসকদের ভারতে যে শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থাপিত হয়েছিল, তার ফলশ্রুতিতে দেশ বৈজ্ঞানিক ও শিল্পক্ষেত্রে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করতে সক্ষম হয়। গুপ্তযুগকে বলা হয় ভারতের স্বর্ণযুগ। এই যুগ ছিল আবিষ্কার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বাস্তুবিদ্যা, শিল্প, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ধর্ম ও দর্শনের বিশেষ উৎকর্ষের যুগ; বর্তমান হিন্দু সংস্কৃতি মূলত এই যুগেরই ফসল। গুপ্ত যুুগের আমলে অনেক পণ্ডিত ব্যাক্তি যেমন কালিদাস, আর্যভট্ট, বরাহমিহির, বিষ্ণু শর্মা -এর অবির্ভাব হয়েছিলো। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ সম্রাট।পাল সাম্রাজ্য((৭৫০-১১৭৪ খ্রীষ্টাব্দ))
পাল রাজবংশ প্রাচীন বাংলার একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজবংশ। এর প্রতিষ্ঠাতার নাম গোপাল। পাল বংশের বিস্তার ৭৫০-১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।৫ মাৎস্যন্যায় শশাঙ্কের পর দীর্ঘদিন বাংলায় কোন যোগ্য শাসক ছিলনা। ফলে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় শাসন শক্তভাবে ধরার মত কেউ ছিলনা। সামন্ত রাজারা প্রত্যেকেই বাংলার রাজা হওয়ার কল্পনায় অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে থাকেন। এ অরাজকতাপূর্ণ সময় (৭ম-৮ম শতক) কে পাল তাম্র শাসনে আখ্যায়িত করা হয়েছে মাৎস্যন্যায় বলে। পুকুরে বড় মাছগুলো শক্তির দাপটে ছোট মাছ ধরে ধরে খেয়ে ফেলার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে বলে ‘মাৎস্যন্যায়ঽ। বাংলার সবল অধিপতিরা এমনি করে ছোট ছোট অঞ্চলগুলোকে গ্রাস করেছিল।
৫ গোপাল (৭৫৬-৭৮১ সাল) ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে পাল রাজত্বের উত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলার অরাজক পরিস্থিতির অবসান ঘটে। পাল বংশের প্রথম রাজা ছিলেন গোপাল। বাংলায় প্রথম বংশানুক্রমিক শাসন শুরু হয় পাল বংশের রাজত্বকালে। পাল বংশের রাজারা একটানা চারশত বছর এদেশ শাসন করেছিলেন। এত দীর্ঘ সময় আর কোন রাজবংশ এদেশ শাসন করেনি। পাল বংশের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
৫ ধর্মপাল (৭৮১-৮২১ সাল) পাল রাজাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন গোপালের পুত্র ধর্মপাল। তার যুগে তিনটি রাজবংশ প্রতিযোগিতায় নেমেছিল উত্তর ভারতে আধিপত্য বিসত্মার করতে। একটি বাংলার পাল বংশ, অন্যটির রাজপুতানার গুর্জর প্রতীহার বংশ এবং তৃতীয়টি দাড়্গিণাত্যের রাষ্ট্রকুট বংশ। ইতিহাসে এ যুদ্ধ পরিচিত হয়েছে ত্রিশক্তির সংঘর্ষ নামে।
৫ রামপাল (১০৮২-১১২৪ সাল) পাল বংশের সর্বশেষ রাজা ছিলেন রামপাল। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত গ্রন্থ থেকে রামপালের রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়। বরেন্দ্র এলাকায় পানিকষ্ট দূর করার জন্য তিনি অনেক দীঘি খনন করেন। দিনাজপুর শহরের নিকট যে রামসাগর রয়েছে তা রামপালের কীর্তি।
রাষ্ট্রকূট রাজবংশ(৭৫৩-৯৮২)
রাষ্ট্রকূট রাজবংশ হল খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ থেকে দশম শতাব্দীতে ভারতে রাজত্বকারী একটি রাজবংশ। রাষ্ট্রকূটদের সবচেয়ে পুরনো যে লেখটি এখনও পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে, সেটি হল সপ্তম শতাব্দীর। এই তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, আধুনিক মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের মালওয়া অঞ্চলের মানপুর তাঁরা শাসন করতেন। অন্যান্য কয়েকটি লেখা থেকে সমসাময়িক আরও কয়েকটি রাষ্ট্রকূট শাসকগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এঁরা হলেন অচলপুর (অধুনা মহারাষ্ট্র রাজ্যের এলিচপুর) ও কনৌজের রাজা। রাষ্ট্রকূটদের উৎপত্তি, আদি নিবাস ও ভাষা নিয়ে একাধিক বিতর্কিত মত প্রচলিত আছে।এলিচপুরের শাসকরা ছিলেন বাদামি চালুক্যদের সামন্ত। দন্তিদূর্গের রাজত্বকালে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মণকে পরাজিত করে অধুনা কর্ণাটক রাজ্যের গুলবার্গ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য। ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতে রাষ্ট্রকূটরা প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। সেই সময় থেকেই এঁদের মান্যখেতের রাষ্ট্রকূট বলা হত। এই সময়ই পূর্ব ভারতে বিহার-পশ্চিমবঙ্গের পাল রাজবংশ এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে মালওয়ার প্রতিহার রাজবংশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। আরবি গ্রন্থ সিলসিলাতুত্তাভারিখ-এর (৮৫১) মতে, রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের প্রধান চারটি সাম্রাজ্যের একটি।
অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে গাঙ্গেয় উপত্যকায় কনৌজের দখল নিয়ে উক্ত তিনটি প্রধান সাম্রাজ্যের সংঘাতবাধে। মান্যখেতের রাষ্ট্রকূটদের সাম্রাজ্য উত্তরে গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চল থেকে দক্ষিণে কুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যে স্থাপত্য ও সাহিত্যেরও বিশেষ উন্নতি ঘটেছিল। প্রথম দিকের রাষ্ট্রকূট রাজারা ছিলেন হিন্দু। পরবর্তীকালে তাঁরা জৈনধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন।
রাষ্ট্রকূট শাসনকালে জৈন গণিতবিদ ও পণ্ডিতেরা কন্নড় ও সংস্কৃত ভাষায় বহু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা প্রথম অমোঘবর্ষ কবিরাজমার্গ নামে একটি বিখ্যাত কন্নড় গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। দ্রাবিড় স্থাপত্য রাষ্ট্রকূট রাজত্বে বিশেষ উন্নতি লাভ করেছিল। এই স্থাপত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল ইলোরা গুহার কৈলাসনাথ মন্দির (অধুনা মহারাষ্ট্র রাজ্যে), কাশীবিশ্বনাথ মন্দির ও জৈন নারায়ণ মন্দির (অধুনা কর্ণাটক রাজ্যে)। এই সবকটী এখন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
ইসলামের ভারত বিজয়
ইসলামের ভারত বিজয অষ্টম শতাব্দীতে মুহাম্মদ বিন কাশিমের মাধ্যমে ইসলামি সভ্যতা ভারতীয় উপমহাদেশের বেলুচিস্তান এবং সিন্ধ অঞ্চলে উপস্থিত হয়। ইসলামি সভ্যতা আসার পর দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত দিল্লী সুলতান ও মুঘল সাম্রাজ্য উত্তর ভারতে শাসন করে। মোঘল যুগে শিল্প এবং স্থাপত্যের দিকে এক অভিনব দিক উন্মোচন ঘটে। অতপর সলতান মাহমুদ গজনবী ১৭বার ভারতবর্ষে আক্রমণ করেন। প্রতিবারই তিনি বিজয়ী হয়ে স্বদেশ আফগানিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেন।ভারতে ইসলামি সাম্রাজ্য((১২০৬-১৫৯৬))
অষ্টম শতাব্দীতে মুহাম্মদ বিন কাশিমের মাধ্যমে ইসলামের ভারত বিজয পর ভারতে
ইসলামি সাম্রাজ্য শুরু হয়। ইসলামি সভ্যতা ভারতীয় উপমহাদেশের বেলুচিস্তান
এবং সিন্ধ অঞ্চলে উপস্থিত হয়। ইসলামি সভ্যতা আসার পর দশম থেকে পঞ্চদশ
শতাব্দী পর্যন্ত দিল্লী সুলতান ও মুঘল সাম্রাজ্য উত্তর ভারতে শাসন করে।
দিল্লি সালতানাত(১২০৬-১৫২৬)
দিল্লি সালতানাত বলতে মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনকালকে বুঝানো
হয়। ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতে রাজত্বকারী
একাধিক মুসলিম রাজ্য ও সাম্রাজ্যগুলি দিল্লি সালতানাত নামে অভিহিত। এই সময়
বিভিন্ন তুর্কি ও আফগান রাজবংশ দিল্লি শাসন করে। এই রাজ্য ও সাম্রাজ্যগুলি
হল: মামলুক সালতানাত (১২০৬-৯০), খিলজি রাজবংশ (১২৯০-১৩২০), তুঘলক রাজবংশ
(১৩২০-১৪১৩), সৈয়দ রাজবংশ (১৪১৩-৫১) এবং লোদি রাজবংশ (১৪৫১-১৫২৬)। ১৫২৬
সালে দিল্লি সালতানাত উদীয়মান মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিশে যায়।
বিজয়নগর সাম্রাজ্য(১৩৩৬-১৬৪৬)
বিজয়নগর সাম্রাজ্য ইজাযানাগারা ; ইজাযানাগারা ছিল দক্ষিণ ভারতের একটি
মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্য। পর্তুগিজরা এই সাম্রাজ্যকে বিসনাগা রাজ্য নামে
অভিহিত করে। ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম হরিহর ও তাঁর ভ্রাতা প্রথম বুক্কা
রায় এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে দক্ষিণ ভারতে
ইসলামি আক্রমণ প্রতিহত করে এই সাম্রাজ্য নিজস্ব প্রভাব বিস্তারে সক্ষম
হয়। ১৬৪৬ সাল পর্যন্ত এই সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। তবে ১৫৬৫ সালে
দাক্ষিণাত্য সুলতানির নিকট যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এই সাম্রাজ্যের পতনের
সূত্রপাত ঘটে। এই সাম্রাজ্য তার রাজধানী বিজয়নগরের নামে চিহ্নিত। বর্তমান
কর্ণাটক রাজ্যের হাম্পিতে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে একটি বিশ্বঐতিহ্য
স্থল। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় পর্যটক ডোমিনগো পেজ, ফার্নাও নানস ও নিকোলো ডি
কন্টি প্রমুখের রচনা এবং স্থানীয় সাহিত্য থেকে এই সাম্রাজ্যের ইতিহাস
সম্পর্কে জানা যায়। বিজয়নগরের শক্তি ও সমৃদ্ধির প্রমাণ মিলেছে
পুরাতাত্ত্বিক খননকার্যের মাধ্যমে।
এই সাম্রাজ্যের নিদর্শন স্বরূপ নানা স্থাপত্য ছড়িয়ে রয়েছে সমগ্র দক্ষিণ
ভারত জুড়ে। এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন অবশ্যই হাম্পি। দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন
মন্দির নির্মাণশৈলীগুলির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল বিজয়নগর স্থাপত্য। এর
হিন্দু নির্মাণশৈলীর মধ্যে সকল ধর্মবিশ্বাস ও স্থানীয় শৈলীগুলির মিলন
ঘটেছিল। স্থানীয় গ্র্যানাইট পাথরে এই শৈলী গড়ে ওঠে। ধর্মনিরপেক্ষ রাজকীয়
স্থাপত্য নিদর্শনগুলিতে উত্তর দাক্ষিণাত্য সুলতানির প্রভাব সুস্পষ্ট। দক্ষ
প্রশাসন ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কল্যাণে এই সাম্রাজ্যে জলসেচের নতুন
প্রযুক্তি আমদানি করা সম্ভব হয়। বিজয়নগর সাম্রাজ্য শিল্প ও সাহিত্যের
পৃষ্ঠপোষক ছিল। কন্নড়, তেলুগু, তামিল ও সংস্কৃত সাহিত্যে এই সাম্রাজ্যের
পৃষ্টপোষকতায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়। কর্ণাটকী সংগীত এই সাম্রাজ্যের
রাজত্বকালেই তার বর্তমান রূপটি লাভ করে। দক্ষিণ ভারতে ইতিহাসে হিন্দুধর্মকে
কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় সংহতি সাধনের মাধ্যমে বিজয়নগর সাম্রাজ্য এক
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
মুঘল সাম্রাজ্য(১৫২৬-১৮৫৮)
মারাঠা সাম্রাজ্য(১৬৭৪-১৮১৮)
মারাঠা সাম্রাজ্য হল একটি ঐতিহাসিক সাম্রাজ্য, যা খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ
শতাব্দী হতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত (১৬৭৪ - ১৮১৮) ভারতবর্ষের
প্রায় সমগ্র অংশ জুড়ে বিদ্যমান ছিলো। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ছত্রপতি
শিবাজী। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মারাঠা সাম্রাজ্য পেশওয়ার
অধীনে বহুগুণ বিস্তৃত হয়।বিস্তারের সর্বোচ্চ সময়ে এটি উত্তরে পেশোয়ার
থেকে দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড়ু পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংস
হলে ভারতে শেষ হিন্দু সাম্রাজ্য হিসেবে মারাঠা সাম্রাজ্যকেই বিবেচনা করা
হয়। ১৭৬১ সালে মারাঠারা পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে পরাজিত হয় যা উত্তর দিকে
তাদের সাম্রাজ্যের বিস্তার রোধ করে।এর ফলে উত্তরভারত কার্যত কিছুদিন মারাঠা
সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে যায়। যদিও ১৭৭০ সালে উত্তরভারত আবার
মারাঠাসাম্রাজ্যের অধীনে আসে। পরবর্তীতে মারাঠা সাম্রাজ্য সম্রাটের অধীনে
কেন্দ্রীয় ভাবে শাসিত হওয়ার পরিবর্তে পেশোয়াদের অধীনে বিভক্ত হয়ে যায় ও
কনফেডারেসি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।১৮১৮ সালের মধ্যে ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে
ব্রিটিশদের কাছে মারাঠা সাম্রাজ্য চূড়ান্ত পরাজয় স্বীকার করে।এর ফলেই
কার্যত ভারতের উপর ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাম্রাজ্যের একটি বৃহৎ অংশ ছিল সমুদ্রবেষ্টিত এবং কানোজি আংরের মতো দক্ষ
সেনাপতির অধীনস্থ শক্তিশালী নৌ-বাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত। তিনি প্রতিপক্ষের,
বিশেষত পর্তুগিজ ও ব্রিটিশদের নৌ-আক্রমণ সাফল্যের সাথেই প্রতিহত করেন।
সুরক্ষিত সমুদ্রসীমা এবং শক্তিশালী দুর্গব্যবস্থা মারাঠাদের সামরিক ইতিহাসে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ব্রিটিশ ভারত(১৮৫৮–১৯৪৭)
ব্রিটিশ ভারত বা ব্রিটিশ রাজ আক্ষরিক অর্থে শাসন বলতে ১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ সালের
মধ্যবর্তী সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে বোঝায়। উক্ত
শব্দদুটির দ্বারা ভারতে ব্রিটিশ অধিরাজ্য ও তার অধীনস্থ শাসনকেও বোঝায়।
বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বিভক্ত এই সাম্রাজ্যের
অন্তর্গত ছিল প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ-শাসিত প্রদেশ ও ব্রিটিশ রাজশক্তির করদ
রাজ্যসমূহ। ১৮৭৬ সালে সমগ্র অঞ্চলটিকে সরকারিভাবে ভারতীয় সাম্রাজ্য নামে
অভিহিত করা হয় এবং এই নামেই পাসপোর্ট ইস্যু করা হতে থাকে। ভারত নামে এই
দেশ লিগ অফ নেশনস ও রাষ্ট্রসংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এই নামেই ভারত ১৯০০,
১৯২০, ১৯২৮, ১৯৩২ ও ১৯৩৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে।
১৮৫৮ সালে ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে
ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে স্থানান্তরিত হন। রানি ভিক্টোরিয়া নিজ হস্তে
ভারতের শাসনভার তুলে নেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ
ভারতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৬ সালে ভিক্টোরিয়া ভারত সম্রাজ্ঞী উপাধি
গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য ভারতীয় অধিরাজ্য
(পরবর্তীকালে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র) ও পাকিস্তান অধিরাজ্য (পরবর্তীকালে
পাকিস্তান) নামে দুটি অধিরাজ্যে বিভক্ত হলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান
ঘটে। ১৯৩৭ সালে ব্রহ্মদেশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে এই
দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
ভারত বিভাজন
ভারত বিভাজন হল ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক বিভাজন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট
ব্রিটিশ ভারত ভেঙে হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামে দুটি
সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা হয়। পাকিস্তান অধিরাজ্য পরবর্তীকালে আবার
দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামে দুটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
ভারত অধিরাজ্য পরবর্তীকালে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র বা ভারত গণরাজ্য নামে
পরিচিত হয়। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের ফলে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল
প্রেসিডেন্সি ও পাঞ্জাব প্রদেশও দ্বিখণ্ডিত হয়। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ভেঙে
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য (ভারত) ও পূর্ব বাংলা।পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ (পাকিস্তান)
গঠিত হয়। পাঞ্জাব প্রদেশ ভেঙে পাঞ্জাব প্রদেশ (পাকিস্তান) ও পাঞ্জাব
রাজ্য (ভারত) গঠিত হয়। ভারত বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতীয়
সেনাবাহিনী, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস ও অন্যান্য প্রশাসনিক কৃত্যক এবং
রেলপথ ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় সম্পদ দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত করে দেওয়া
হয়।
ভারত বিভাজনের অব্যবহিত পূর্বে পাঞ্জাব অঞ্চলে যে ধর্মীয় দাঙ্গা বেধেছিল,
তাতে উভয় ধর্মের ২০০,০০০ থেকে ৫০০,০০০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
ইউএনএইচসিআর-এর হিসেব অনুসারে, ১ কোটি ৪০ লক্ষ হিন্দু, শিখ ও মুসলমান ভারত
বিভাজনের ফলে বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন এবং এর ফলে মানব ইতিহাসের বৃহত্তম
দেশত্যাগের ঘটনাটি ঘটেছিল।
সিলোন (অধুনা শ্রীলঙ্কা) ১৭৯৫ থেকে ১৭৯৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের
মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারপর এটি ভারত থেকে পৃথক হয়ে
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি পৃথক ক্রাউন কলোনি ঘোষিত হয়। ১৮২৬-৮৬ সালের
মধ্যে ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে ব্রহ্মদেশকে (অধুনা মায়ানমার) ব্রিটিশ ভারতের
অন্তর্ভুক্ত করেছিল। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ব্রহ্মদেশ ছিল ব্রিটিশ ভারতীয়
প্রশাসনের দ্বারা শাসিত অঞ্চল। তারপর থেকে ব্রহ্মদেশ পৃথকভাবে শাসিত হতে
থাকে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ব্রহ্মদেশ এবং ওই বছরই ৪ ফেব্রুয়ারি সিলোন
স্বাধীনতা পায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাকিস্তান
দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। ভারত থেকে সিলোন ও
ব্রহ্মদেশের বিভাজন বা পাকিস্তানের বিভাজন ভারত বিভাজনের অন্তর্গত নয়।
ভুটান, নেপাল ও মালদ্বীপ – এই তিনটি অধুনা দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রে ভারত
বিভাজনের কোনো প্রভাব পড়েনি। নেপাল ও ভুটান ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তির
মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করেছিল এবং কখনই ব্রিটিশ ভারতীয়
সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তাই এই দুই রাষ্ট্রের সীমা ভারত বিভাজনের
সময় অপরিবর্তিত থেকে যায়। মালদ্বীপ ১৮৮৭ সালে ব্রিটিশ ক্রাউনের
প্রোটেক্টোরেট মর্যাদা পায় এবং ১৯৬৫ সালে স্বাধীন হয়। এই রাষ্ট্রের সীমাও
ভারত বিভাজনের সময় অপরিবর্তিত ছিল।
No comments:
Post a Comment