খ্রিস্টপূর্ব
২৬০০ বছর আগে গড়ে উঠেছিলো মায়ান সভ্যতা। মায়ান সভ্যতার কথা শুনলে ভেবেই
পাওয়া যায় না যে, সেই চার হাজার বছর আগে কীভাবে তারা এতো উন্নত হয়েছিলো?
যখন পৃথিবীর মানুষ বাড়িঘরই ঠিকঠাক বানাতে শেখেনি, কেবল আগুন জ্বালিয়ে খাবার
সেদ্ধ করা শিখেছিলো, সেই সময় তারা কীভাবে পাথর দিয়ে তৈরি করেছিলো বিশাল
বিশাল সব ঘরবাড়ি। সে সময় অধিকাংশ জাতির ভাষাই পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি, তখন তারা
তাদের ভাষায় এমনকি একরকম ক্যালেন্ডারও বানিয়ে ফেলেছিলো। চাঁদ, তারা, গ্রহ
নক্ষত্র নিয়েও তারা পড়াশুনা করত। অর্থাৎ জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা করতো। শুধু
তাই নয়, তারা গান গাইত, কবিতা লিখত, রীতিমতো সাহিত্য চর্চা করতো! পুরো
আমেরিকা মহাদেশজুড়ে মায়ান সভ্যতাই একমাত্র প্রাচীন সভ্যতা, যাদের নিজস্ব
লেখা ভাষা ছিলো, যারা সুন্দর করে পড়তে ও লিখতে জানতো।
কিন্তু কীভাবে জন্ম হলো মায়ান সভ্যতার? কীভাবেই বা এই সভ্যতা সেই আদিম যুগেও এতো বিকশিত হলো?
মায়ানদের
সম্পর্কে অবাক করা কিছু তথ্য জানা গেছে। এতো প্রাচীন কালে তাদের এসব আচার
আচরণ সবাইকে বিস্মিত করে। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক তথ্যগুলো-
মায়ানরা
অন্যান্য সভ্যতার মতো লোহা বা ব্রোঞ্জের অস্ত্র ব্যবহার করতো না। তারা
অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো আগ্নেয় শিলা অথবা অবিসিয়ান অর্থাৎ কাঁচের মতো
দেখতে এক প্রকার পাথর। মায়ানরা চ্যাপ্টা কপালের অধিকারী ছিলো। তাদের জাতির
গুনী মানী ব্যক্তিদের নাক কোণ বিশিষ্ট করার জন্য তারা পুডিং ব্যবহার করতো।
অর্থাৎ আজকালকার প্লাস্টিক সার্জারির ধারণা হয়েতো সেখান থেকেই পেয়েছে
মানুষ। সমাজের অভিজাত নারীরা দাঁতে বিন্দু এঁকে নকশা করতো। ব্যাবিলনীয়দের
পাশাপাশি মায়ানরা ইতিহাসে সর্বপ্রথম জমি পরিমাপের ক্ষেত্রে শূন্যের ব্যবহার
করেছিলো। তারা বন্দী বা দাসদের মেরে ফেলার আগে সারা গায়ে নীল রঙে রাঙিয়ে
নিতো। মেরে ফেলার আড়ে তারা বন্দীদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালাতো। এমনকি
তাদের পিরামিডের উপর শুইয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে হৃদপিণ্ড বের করে ফেলতো। কখনো
কখনো বন্দীদের চামড়া তুলে ফেলা হতো। মধ্যযুগেও এ ধরনের বর্বরতা ছিলো, যাকে
স্কাফিজম নামে অবহিত করা হয়। বন্দীদের গায়ের চামড়া তুলে ফেলার পর মায়ানদের
ধর্মযাজক সেই চামড়া পরে নাচ পরিবেশন করতো।
মায়ানরা
যে জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী ছিলো তার অন্যতম উদাহরণ হলো তাদের তৈরি
ক্যালেন্ডার। তাদের ৩ টি ক্যালেন্ডার ছিলো। তার মধ্যে একটি ছিলো `হাব`
যেখানে বছরকে আধুনিক ক্যালেন্ডারের মতোই ৩৬৫ দিনে ভাগ করা হয়েছিলো। তাদের
দীর্ঘতম ক্যালেন্ডারটি ছিলো ২৮ লাখ ৮০ হাজার দিনের। তাদের সে হিসেব অনুযায়ী
ক্যালেন্ডারটি শেষ হয় ২০১২ সালে। তারা এ দিনটিকে পৃথিবী ধ্বংসের
ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। তবে তাদের সে ভবিষ্যদ্বাণী ফলেনি।
মায়ানদের
লেখার পদ্ধতি সমসাময়িক যেকোনো সভ্যতার তুলনায় অগ্রবর্তী ছিলো। তারা যেকোনো
কিছুর উপরেই লিখতেন, যা সামনে পেতেন তার উপরই, এমনি দালানের দেয়ালেও।
স্পেন যখন মায়ান সাম্রাজ্য দখল করে নেয়, তখন তাদের লেখনীর অনেক কিছুই
ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তবু ২০-২১ শতকে তাদের অনেক লেখা ল্যাবটরিতে অনুবাদ করা
গেছে। মায়ানদের চিকিৎসাবিদ্যা অনেক আধুনিক ছিলো। তারা শরীরের ক্ষত মানুষের
চুল দিয়েই সেলাই করে ফেলতো। দাঁতের গর্ত পূরণ করা, এমনকি নকল পা লাগানোতেও
পারদর্শী ছিলো তারা। তারা প্রকৃতি থেকে ব্যথানাশক সংগ্রহ করতো, সেই সব
গাছগাছড়া তারা পূজায় ব্যবহার করতো। ধর্মীয় রীতি অনুসারে আবার ওষুধ হিসেবেও
ব্যবহার করতো। রোগীকে অজ্ঞান করার জন্যও তারা ওষুধের ব্যবহার জানতো।
মায়ানরা
চিত্ত বিনোদনের ক্ষেত্রেও বেশ এগিয়ে ছিলো। এর মধ্যে তারা খেলাধূলাও করতো।
খেলাধূলার মধ্যে ‘মেসো আমেরিকান বল খেলা" তে বিশেষ আগ্রহী ছিলো তারা। এর
ময়দানও বেশ অদ্ভূত ধরনের ছিলো। খেলার কোর্টের মাঝখানে সমতল আর দুপাশে দুটো
ঢালু মঞ্চের মতো স্টেজ। তার সামনের দেয়ালে গোল ছিদ্র সমৃদ্ধ লোহার আংটা
লাগানো থাকতো। খেলোয়াড়রা ওই ছিদ্র দিয়ে একটি রাবারের বল ঢুকানোর চেষ্টা
করতো। তবে বলটি হাত বা পায়ের স্পর্শ ছাড়া কেবলমাত্র কোমর দিয়ে আঘাত করে
ঢুকাতে হতো। মায়ান সাম্রাজ্যের সকল বড় শহরে এই খেলার কোর্ট পাওয়া গেছে।
প্রায়ই তারা খেলার আয়োজন করতো। হেরে যাওয়া দলের শিরচ্ছেদ করা হতো।
মায়ানরা
স্টিম বাথ নিতে পছন্দ করতো। তারা মনে করতো, গোসলের সময় ধোঁয়ার সঙ্গে
তাদের সব পাপ উড়ে যায়। ১৬৯৭ সালে মায়ান সাম্রাজ্য স্প্যানিসদের হাতে চলে
গেলেও মায়ানরা এখনো বিভিন্ন অঞ্চলে টিকে আছে। মায়ান সাম্রাজ্য বিপন্ন হওয়ার
কারণ এখনো এক রহস্যই রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, খরা, দুর্ভিক্ষ, অধিক
জনসংখ্যা এর কারণ হতে পারে। মায়ান সংস্কৃতি, এমনকি ভাষা এখনো মেক্সিকোর
অনেক এলাকায় এবং গুয়েতেমালায় প্রচলিত আছে। পরিসংখ্যান বলে, এখনো ৭ বিলিয়ন
মায়ান আছে, যারা ইউকাটান উপদ্বীপে বসবাস করছে।
অভিজাত মায়ান পরিবারে মায়েরা শিশুদের কপাল ঘষে দিতো। যাতে কপাল চ্যাপ্টা হয়, এমনকি চোখ ট্যারা করানোর চেষ্টাও করতো তারা।
No comments:
Post a Comment